ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা-শেষ

টাকা দিলেই লাইসেন্স, নাটের গুরু শামসুল!

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২১ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৫
টাকা দিলেই লাইসেন্স, নাটের গুরু শামসুল! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহে এখন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দাপট। শহরের চরপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী, ভাটিকাশর ও বাঘমারা এলাকায় গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে নামসর্বস্ব ও নিম্নমানের অসংখ্য ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

যেগুলোর অধিকাংশেই স্থায়ী চিকিৎসক, দক্ষ টেকনিশিয়ান, নার্স, আয়া বা অন্যান্য স্টাফ না থাকায় চিকিৎসার নামে চলছে অপচিকিৎসা। হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। কিন্তু ঠিকই প্রতিনিয়তই কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্লিনিকওয়ালারা।

সম্প্রতি শহরের ক্লিনিকপাড়ার বেপরোয়া এই চিকিৎসা বাণিজ্য ও অনিয়মের নানা দিক অনুসন্ধান করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। পড়ুন শেষ পর্ব

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ শহরের অলি-গলিতে, পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠা ক্লিনিক, প্যাথলজি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালে চলছে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা। প্রশ্ন উঠেছে চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে। অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনাই এসব কেন্দ্রের দৃশ্যমান অবস্থা। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে- সেগুলোর সরকারি অনুমোদন পাওয়ারই কথা নয়।

সেগুলো কী করে অনুমোদন পেলো এ প্রশ্নের উত্তরে বাংলানিউজের তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, টাকা দিলেই এখানে অনুমোদন মেলে। আর দিনের পর দিন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের হয়ে এমন কাজটি করে চলেছে মযমনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন অফিস। ফলে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সরকারি এ অফিসটি।

Clinic_List_Mymensinghঅবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে লাইসেন্স প্রদান, অভিযোগ সম্পর্কে ব্যবস্থা না নিয়ে উৎকোচ আদায়, মাসোহারাবাজিসব নানা কারণে জেলা শহরের ক্লিনিকপাড়ার অবস্থা বেহাল। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের উদাসীনতায় বেশিরভাগ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে সীমাহীন ও বেপরোয়া দুর্নীতি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৫শ’ বিছানা থেকে নতুন ভবনে আরো ৫শ’ বিছানাসহ মোট ১ হাজার শয্যায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বিছানার তিনগুণ রোগী এখানে ভর্তি থাকে। ফলে বাড়তি রোগীর চাপে শহরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো রোগী পাচ্ছে।

দালাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রোগী এনে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা চালানো হচ্ছে। জেলা শহরের মোট অনুমোদিত ক্লিনিক রয়েছে ১০৯টি। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৭৯টি। জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্র বলছে, ৭ থেকে ৮টি ছাড়া বাদ বাকী ক্লিনিকগুলো লাইসেন্স নিয়েছে।

হাতেগোনা কয়েকটি বাদে প্রায় সব ক’টির লাইসেন্স পাবার যোগ্যতা না থাকলেও তারা কীভাবে লাইসেন্স পেয়েছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা সিভিল সার্জন অফিস কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।

মূলত জেলা সিভিল সার্জন অফিস ম্যানেজ করেই সরকারি নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চিকিৎসা সেবার নামে কসাইখানা বানানোর কাজ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে চলছে।

আর সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা মনগড়া হাজিরা দিয়ে ছোটেন প্রাইভেট ক্লিনিকে। তাদের কাছে অধিক গুরুত্ব পায় এসব ক্লিনিক।

অভিযোগ রয়েছে, ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন পদে সম্প্রতি পালাবদল ঘটেছে। নতুন সিভিল সার্জন এলেও স্বাস্থ্য ব্যবসার কেন্দ্রগুলোতে কোন খবর নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে জেলা সিভিল সার্জন অফিসে নিয়মিত নজরদারি করার কথা থাকলেও তারা সেই কাজটি করছেন না। বেপরোয়া চিকিৎসা বাণিজ্য বন্ধেও তাদের কোন তৎপরতা নেই।

আর এমন নির্বিকার ভূমিকার কারণ জেলা সিভিল সার্জন অফিসের দুর্নীতি ফুলেফেঁপে উঠছে। মাসোহারা, উৎকোচবাজির মাধ্যমেই সিভিল সার্জন অফিস ক্লিনিকপাড়ায় দুর্বল নজরদারি চালায়।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, জেলা সিভিল সার্জন অফিসের সাঁট মুদ্রাক্ষরিক (স্টেনো টাইপিস্ট) শামসুল আলম ইতোমধ্যে ক্লিনিকপাড়ায় উৎকোচবাজির জন্য বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি আছেন একই কর্মস্থলে।

সবকিছু নখদর্পণে থাকায় অনুমোদনবিহীন ও অনুমোদনপ্রাপ্ত বিভিন্ন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রতি মাসে সুবিধা হাতিয়ে নেন এ নাটের গুরু। অভিযোগ এলেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তা ধামাচাপা দেন। আবার তার মাসোহারার টাকার ভাগ যায় সংশ্লিষ্ট অফিস সহকারী মোখলেছুর রহমানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের পকেটে।

সূত্র জানায়, শামসুল আলমের নেতৃত্বে দুর্নীতির এ দুষ্টচক্রের কারণেই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার নামের অসংখ্য দোকান। তাদের সীমাহীন দৌরাত্ম এখনো অব্যাহত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক বাংলানিউজকে জানান, শামসুল আলমের নেতৃত্বে জেলা সিভিল সার্জন অফিসের একটি সিন্ডিকেট সব সময় সক্রিয়। স্বার্থের বিনিময়ে নীরব তারা। দুর্নীতির রাহুগ্রস্ততায় যেন আটকে পড়েছে এ প্রতিষ্ঠান। এখানে জবাবদিহিতার নুন্যতম বালাই নেই।

চিকিৎসা সেবার নামে এমন অরাজকতার জন্য জেলা সিভিল সার্জন অফিসের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা: এ.কে.এম.ওয়ালিউল্লাহ বলেন, সিভিল সার্জন অফিসের কেরানিদের টাকা দিলেই লাইসেন্স পাওয়া যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি সিভিল সার্জন। তিনিই সবকিছু দেখে লাইসেন্স দেবার মালিক। কিন্তু তারাই খেয়াল করেন না। এ বিষয়ে সিভিল সার্জন অফিস ও প্রশাসন শক্ত অবস্থান না নিলে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা এসব সমস্যা সমাধানে সিভিল সার্জনকেই আন্তরিক হতে হবে।

সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে এসব কথিত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর তাদের ব্যবসা পরিচালনা করা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোস্তফা কামাল বলেন, সরকারি অনুমোদন চেয়ে ক্লিনিক মালিকরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি’র কাছে আবেদন করেন। সেখান থেকে আমাদের চিঠি দেয়া হলে আমরা দেখেশুনে লাইসেন্স দিই।

নিজ অফিসের শামসুল আলমের নেতৃত্বে দুর্নীতির দুষ্টচক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে উল্টো তিনি প্রশ্ন করেন, ক্লিনিক মালিকরা তাকে টাকা দেয় কেন?

নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা শামসুল আলম বলেন, কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, এ কথা আমার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ বলতে পারবে না। কোন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক আমার কাছে এলে আমি শুধু কাগজপত্র ঠিকঠাক করেই দেই। কিন্তু টাকা দিলেই এখানে লাইসেন্স মেলে, এমন কথা বানোয়াট।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৫
জেডএম

** অনৈতিক কর্মকাণ্ডও চলে ক্লিনিকপাড়ায়
** সড়কজুড়ে রোগী ঠকানো বাণিজ্য!
** হাসপাতালের সামনেই ক্লিনিক-প্যাথলজির জঞ্জাল
** ৪ শতাধিক পেশাদার দালাল, আতঙ্ক ‘রোগী ধরা’
** পিয়ন ও ওটি বয় থেকে ক্লিনিক মালিক!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।