ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা-৪

পিয়ন ও ওটি বয় থেকে ক্লিনিক মালিক!

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪২ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
পিয়ন ও ওটি বয় থেকে ক্লিনিক মালিক! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহে এখন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দাপট। শহরের চরপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী, ভাটিকাশর ও বাঘমারা এলাকায় গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে নামসর্বস্ব ও নিম্নমানের অসংখ্য ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

যেগুলোর অধিকাংশেই স্থায়ী চিকিৎসক, দক্ষ টেকনিশিয়ান, নার্স, আয়া বা অন্যান্য স্টাফ না থাকায় চিকিৎসার নামে চলছে অপচিকিৎসা। হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। কিন্তু ঠিকই প্রতিনিয়তই কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্লিনিকওয়ালারা।

সম্প্রতি শহরের ক্লিনিকপাড়ার বেপরোয়া এই চিকিৎসা বাণিজ্য ও অনিয়মের নানা দিক অনুসন্ধান করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। পড়ুন চতুর্থ পর্ব
   
ময়মনসিংহ: মাত্র বছর ছয়েক আগেও শহরের আল-আরাফা প্রাইভেট হাসপাতালে পিয়ন হিসেবে কাজ করতেন শরীফ। সেখানেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠে দালালদের সঙ্গে। বুঝে ফেলেন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসা। অবশেষে দিয়ে বসেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। শহরের চরপাড়া এলাকায় এখন তিনিসহ কয়েক জন মিলে গড়ে তুলেছেন গ্রামীণ প্রাইভেট হাসপাতাল।

রেনেসা নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে পিয়ন ছিলেন রবিউল। এখন তিনিও একটি ক্লিনিকের মালিকানায় নাম লিখিয়েছেন। নাম দিবারাত্রি হাসপাতাল। এ ক্লিনিকটি নিয়ে যদিও ক্লিনিকপাড়াতেই রয়েছে মুখরোচক নান আলোচনা-সমালোচনা।

শহরের আল বারাকা প্রাইভেট হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার (ওটি) বয় ছিলেন তারেক। এখন তারা কয়েকজন মিলে মাল্টি কেয়ার হাসপাতালের মালিক। একইভাবে সেফওয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অভ্যর্থনা কক্ষে এক সময় দায়িত্ব পালন করা রুবেল আরো ক’জনকে সঙ্গে নিয়ে দিয়েছেন কিউর ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

শুধু শরীফ, তারেক, রুবেল বা রবিউলই নন, এরকম অন্তত আরো অর্ধ শতাধিক ব্যক্তি রীতিমতো ক্লিনিক মালিক বনে গেছেন। আয়া ও নার্স থেকে শুরু করে টেকনিশিয়ান পর্যন্ত অনেকেই স্বল্প পুঁজির ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালের ব্যবসা খুলে বসেছেন। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের চেয়ার-টেবিল ম্যানেজ করে টাকার বিনিময়ে হাতিয়ে নেন কাগজ।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আন্ডার গ্রাউন্ড বিভিন্ন ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী এলেও সময়মতো ডাক্তার আসে না। তখন আর কী করা? মালিক, ম্যানেজাররা ডাক্তারের গাউন পরে সেজে বসেন সার্জন। অপারেশন থিয়েটার তৈরি। ছোটখাট অপারেশন নিজেই করে থাকেন! 

পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়, রিপোর্ট লিখে দেন নিজেরাই। রোগীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে ধরিয়ে দেন ভূয়া ব্যবস্থাপত্র। ফলাফল- রোগ আর ভাল হয় না। রোগীর পরিস্থিতি হয়ে যায় জটিল। তখন দালালরা নিয়ে যায় অন্য প্রতিষ্ঠানে। এভাবে ক্লিনিক থেকে ক্লিনিকে গড়ায় রোগী। সুচিকিৎসার দেখা মেলে না।

উদাহরণ টেনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ক্লিনিক মালিক জানান, মনির উদ্দিন ক্লিনিকে এ.বি.সিদ্দিক নামের একজন রয়েছেন। তিনি নামের আগে ‘ডা:’ শব্দটি ব্যবহার করে রোগীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছেন। কিন্তু তিনি থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তিনি এমবিবিএস পাস করেননি। মেডিকেলেও যাননি কখনো। কিন্তু সেজে বসেছেন চিকিৎসক।

সূত্র জানায়, জামালপুর জেলা সদরের পল্লী চিকিৎসক মোশারফ হোসেন শহরের রাজধানী হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক (লাইসেন্সনং-২৫১০)। সঙ্গে পার্টনার আরিফুল ইসলাম ও আসাদুজ্জামান তালুকদার নামের দু’জন। ইতোমধ্যেই আলোচিত এ হাসপাতালটিতে নিজেই সব রোগের চিকিৎসা করেন এ আনাড়ি। এখানে প্রশিক্ষিত বা ডিপ্লোমা কোন নার্স নেই।

অদক্ষ আয়াদের নার্স সাজিয়ে এম.আর (মাসিক নিয়মিত করণ) এর নামে অহরহ অবৈধভাবে গর্ভপাত ঘটানো হচ্ছে বলে খবর চাউর হয়ে উঠেছে। এ হাসপাতালে এক্সরে, আল্টাসনোগ্রাম, ইসিজি এমনকি ব্লাড প্রেসার মাপার সাধারণ যন্ত্রটিও নেই। এ ক্লিনিকটির বিরুদ্ধে রয়েছে পেশাদার দালাল পালনেরও বিস্তর অভিযোগ।

শহরের ভদ্রবেশী এক টাউট হাসপাতালটির মূল দালাল। রোগী আনা নেয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরকে ম্যানেজ করার দায়িত্বও তার, এমন কথাবার্তা রয়েছে ক্লিনিকপাড়ায়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে ভূইফোঁড় এ হাসপাতালের পরিচালক মোশারফ হোসেনের বক্তব্য জানতে সরেজমিনে এ হাসপাতালটিতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।

শহরের চরপাড়া এলাকার রেজিয়া ক্লিনিকের মালিক দম্পত্তি দু’জনেই এক যুগ আগে ছিলেন শহরের একটি ক্লিনিকের কর্মচারী। স্বামী হাসানুজ্জামান কাজ করতেন আল রাজি ক্লিনিকে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে। তার স্ত্রী সাবিনা নার্স হিসেবে হেনা নার্সিং হোমে চাকরি করতেন।

এখন তারা নিজেরাই মালিক। খুলে বসেছেন রেজিয়া ক্লিনিক, এমন তথ্য নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকের টেকনেশিয়ান আবুল হাসিম।

অভিযোগ রয়েছে, নামসর্বস্ব বেশিরভাগ ক্লিনিকের অভ্যন্তরে চলে অপচিকিৎসা। স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদাসীনতা ও তদারকির অভাবে শহরে বেপরোয়াভাবে গড়ে উঠেছে ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিক প্যাথলজি ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

আয়া, দালালরা ক্লিনিক মালিক হলেও তাদের প্রতিষ্ঠানে সুচিকিৎসার বদলে অপচিকিৎসাকেই উৎসাহিত করে চলেছেন। বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় যৌথবাহিনীর অভিযানে শহরের যেসব ক্লিনিকে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল, জরিমানা করা হয়েছিল, পরবর্তীতে তারা ম্যানেজ করে টাকা পয়সা লেনদেন করে জমজমাট বাণিজ্য শুরু করে।

সূত্র জানায়, ক্লিনিক হাসপাতালের লাইসেন্স গ্রহণের ক্ষেত্রে শর্ত থাকলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই শর্ত পালন না করেই লাইসেন্স নিয়েছে। একাধিক প্রতিষ্ঠান চলছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। সিভিল সার্জন অফিসের অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে শহরে চলছে অনিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য বাণিজ্য।

ময়মনসিংহ শহরে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেছে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। শহরের ভাটিকাশর, বাগমারা, ব্রাক্ষপল্লী, চরপাড়া, মাসকান্দা, ধোপাখোলা মোড়সহ অনেক ক্লিনিক মালিক ছিলেন এক সময় নার্স কিংবা আয়া। আর এ নার্সরাই তাদের পছন্দের দালালদেরকে বিয়ে করে অথবা পার্টনার নিয়ে শুরু করেন ক্লিনিক ব্যবসা।

এসব ক্লিনিক পরিচিত কিছু ডাক্তাররের নাম ব্যবহার করে বড় বড় সাইনবোর্ড লাগিয়ে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে।

জিরো থেকে হিরো হওয়া ক্লিনিক মালিকদের সম্পর্কে রেনেসাঁ জহুরা হাসপাতাল (প্রা:) ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.সাইফুল ইসলাম বলেন, আগে যারা রাস্তাঘাটে ঘুরাঘুরি করে রোগী আনতো, কিংবা বিভিন্ন ক্লিনিক কাম ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পিয়ন, টেকনেশিয়ানের কাজ করতো এখন তারাও ক্লিনিকের মালিক হয়ে গেছেন। অস্তিত্ববিহীন এসব ক্লিনিকের জন্য মার খাচ্ছেন ভাল ক্লিনিকের মালিকরা।

একই রকম মত জেলা সিভিল সার্জন অফিসের সাঁট মুদ্রাক্ষরিক (স্টেনো টাইপিস্ট) শামসুল আলমের। তিনি জানান, বিভিন্ন ক্লিনিকে এক সময় চাকরি করতেন এখন তারাই ক্লিনিকের মালিক হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটির চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সেবার মান ঠিক থাকলেও বেশির ভাগেরই মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সরকারি শর্ত পূরণ না করে শুধু টাকা খরচা করেই এক শ্রেণীর মানুষ রাতারাতি ক্লিনিক মালিক হয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা: এ.কে.এম.ওয়ালিউল্লাহ।

তার মতে, এসব ক্লিনিক ডাক্তার ছাড়াই চলে। মানুষের জীবন নিয়ে এরা প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছে। এর জন্য এক শ্রেণীর চিকিৎসকও দায়ী।

ডা: এ.কে.এম.ওয়ালিউল্লাহ আরো বলেন, এসব ক্লিনিকে ৩ জন চিকিৎসক, ৬ জন পাস করা নার্স দরকার হলেও এসবের বালাই নেই। একজনও ডাক্তার নেই। সার্জন অপারেশনের পর রোগীকে দেখভাল করার জন্যও কেউ থাকে না। এসব ক্ষেত্রে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে টাকা পয়সা খরচা করে মীমাংসা করারও ভুরিভুরি ঘটনা রয়েছে।

তবে ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা: মোস্তফা কামাল এমন বিষয়ে বলেন উল্টো কথা। দিলেন নতুন তত্ত্ব। কারা আয়া বা নার্স থেকে ক্লিনিক মালিক হলো সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমরা দেখি সেবার মান কেমন। তবে এসব প্রতিষ্ঠান যদি নিয়ম মাফিক না চলে তবে অবশ্যই এদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
জেডএম

** ৪ শতাধিক পেশাদার দালাল, আতঙ্ক ‘রোগী ধরা’
** হাসপাতালের সামনেই ক্লিনিক-প্যাথলজির জঞ্জাল
** সড়কজুড়ে রোগী ঠকানো বাণিজ্য!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।