ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

জুন

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার সচেতনতা মাস

ডা. সৃজনী আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৪
পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার সচেতনতা মাস

‘চোখ বন্ধ করলে মনে হয় আমার পাশে লাশ’  রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপে লড়ে যাওয়া একজন উদ্ধারকর্মীর এই উক্তিটি নিশ্চয় অনেকেরই চোখে পড়েছে সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে। গতবছর ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া এই মানবিক বিপর্যয় সংশ্লিষ্ট অনেকের স্মৃতিকে এভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

কোনো এক দুর্যোগের ভেতর দিয়ে পার হবার পর দেখা দিতে পারে এ রকম দুর্যোগ পরবর্তী মানসিক সমস্যা।

এমন কোনো ঘটনা যা একজন ব্যক্তির নিজের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ, সেই ঘটনার মুখোমুখি হলে আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপজনিত রোগ বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দেয়। এটি একটি মানসিক রোগ যা উদ্বিগ্নতাজনিত মানসিক রোগসমূহের অন্তর্গত। ইতিহাসে পূর্বে বিভিন্ন নামে পরিচিত থাকলেও ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ফেরত আসা সৈনিকদের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা এই রোগটিকে ১৯৮০ সালে বর্তমান পরিচয়টি দেয়।          

এ রকম আঘাত পরবর্তী মানসিক সমস্যা ঘটতে পারে যে কারো ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক বড় কোনো দুর্ঘটনা যেমন ঝড়-ভূমিকম্প-বন্যা এগুলোর শিকার হয়ে অথবা মানবসৃষ্ট বিপর্যয় যেমন যুদ্ধের মুখোমুখি হলে অথবা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকের ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগতভাবে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা যেমন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর। দুর্যোগের সরাসরি মুখোমুখি না হয়ে আপনজনকে কোনো দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখলে, কোনো দুর্যোগে দুর্গতদের উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থাকা কর্মীদের মধ্যেও এই রোগটি দেখা দিতে পারে। এমন কি দেখা যায় বহু দিন ধরে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকা ব্যক্তির ঐ নির্যাতনের পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসার পর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে। নারী-পুরুষ-শিশু যে কেউই, যে কোনো বয়সে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।


যুক্তরাষ্ট্রের National Institute of Mental Health এর এক হিসাব মতে দেখা গেছে একটি নির্দিষ্ট বছরে প্রতি ৩০ জনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হন।

ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার পরপর অথবা মাস থেকে বছরকালীন সময়ে এই রোগটি দেখা দিতে পারে। এই রোগের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো- দুঃসহ ঘটনাটির পুনঃপুনঃ স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা, স্মৃতিগুলোর সাথে অতিরিক্ত উদ্বেগ এবং উদ্বেগজনিত শারীরিক সমস্যা, সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি মনে পড়তে পারে এমন পরিবেশ এড়িয়ে চলার প্রবণতা, বিষণ্ণতা এমন কি আত্মহত্যার প্রবণতা। এই লক্ষণগুলোর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যেহেতু এটি একটি মানসিক রোগ তাই এর যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আক্রান্তদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনা যায়। তবে চিকিৎসার জন্য সামগ্রিক একটি কাঠামো এবং ব্যাপক সচেতনতা অত্যাবশ্যকীয়। আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রয়োজনভেদে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা  প্রয়োজন হতে পারে, তদুপরি সর্বস্তরে সচেতনতা না থাকলে রোগটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসার আওতায় আনা এবং চিকিৎসা কাজ যথাযথভাবে চালিয়ে যাওয়াও দুষ্কর।   

রোগটির ভয়াবহতা এবং এই রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ২০১০ সালে ২৭ জুনকে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার সচেতনতা দিবস’ ঘোষণা করে। একই সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের National Center for PTSD জুন মাস কে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার সচেতনতা মাস’ হিসেবে পালন করে আসছে।

The National Center for PTSD ১৯৮৯ এ  গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান যেটি প্রথম দিকে যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের আঘাতজনিত মানসিক রোগ নিয়ে কাজ করা শুরু করে এবং পরবর্তীতে সাধারণ জনগণের জন্যেও এই কার্যক্রম বিস্তৃত করে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ রোগটির প্রতিরোধ, চিকি‍ৎসা, সচেতনতা বিষয়ে শিক্ষা এবং উচ্চতর গবেষণার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

এ বছর প্রতিষ্ঠানটি মাসটিতে প্রতি সপ্তাহে ধারাবাহিকভাবে তাদের ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোকপাত করে প্রকাশনা দিয়ে আসছে। যেমন প্রথম সপ্তাহে ‘কিভাবে এই রোগটি সম্পর্কে জানা যায়’ এভাবে শুরু হয়ে চতুর্থ সপ্তাহে ‘দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা’ এরকম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশনাগুলো দেওয়া হয়েছে। প্রকাশনাগুলোতে নির্দিষ্ট এই বিষয়গুলো নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা, রোগটি নিয়ে সর্বক্ষেত্রের জনগণের করণীয় এই বিষয়গুলোতে আলোকপাত করা হয়েছে।

আমাদের দেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ দেশ এবং সামাজিক অস্থিরতার উপর্যুপরি বৃদ্ধির কারণে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ও বেড়ে চলেছে। সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে এই মানসিক রোগটিতে আক্রান্তদের সংখ্যা। ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ রোগটির যথাযথ চিকিৎসা এবং রোগটির বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা অতি সত্ত্বর প্রয়োজন।

এই রোগটির চিকিৎসার জন্য যেমন মনোচিকিৎসক, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট মনোবিদ, সামাজিক কর্মী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর পদক্ষেপের প্রয়োজন তেমন পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনভাবে অংশগ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা আনয়নে এরূপ নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কার্যক্রম একটি কার্যকর সূচনা আনতে পারে।

ডা. সৃজনী আহমেদ
এম ডি, ফেজ এ, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বি এস এম এম ইউ

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।