ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

বন্ধু বলি তারে...

মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
বন্ধু  বলি তারে...

এমন কেউ কি আছেন যিনি বন্ধু ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারেন? আমার মনে হয় এমন কেউ নেই, যার একজন বন্ধু নেই। কিন্তু আসলেই কি তাকে আমরা সত্যিকারের বন্ধু বলতে পারি? আমার অনেক বন্ধুকেই দেখেছি যারা মাত্র সামান্য পরিচয়ে একজনকে বন্ধু বলে কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতো।

কিন্তু আমি ৬ বছর একসঙ্গে পড়েও আমার অনেক সতীর্থকে জীবনে বন্ধু ভাবতে পারিনি।

অনেকে হয়তো একে আমার অহমিকা ভাবতে পারেন। তবে, তাদের বন্ধু বলতে পারিনি এ কারণেই যে, তাদের কখনো অনুভব করিনি, অভাববোধ করিনি।

বন্ধুত্ব আসলে এমন, যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, বয়স বা গোত্র বিভাজন নেই। জীবনে এমন অনেক বন্ধু মিলে যায়, যাদের জন্য জীবনটা হয়তো আমূল পাল্টে যায়, মুখ তুবড়ে থুবড়ে পড়তে পড়তেও যাদের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়।

আর জাপানে এমন একটা বিষয়কেই তারা kenzoku শব্দ দিয়ে প্রকাশ করে। এর অর্থ ‘family’ বা পরিবার। তবে আমরা পরিবার বলতে যা বুঝি, এ পরিবার তা থেকে অনেকটাই আলাদা।

সাধারণত চিন্তা চেতনার দিক দিয়ে যারা একই ধ্যান-ধারণা পোষণ করে, তাদেরই এর আওতায় ফেলা হয়। একে অন্যের মনের ভাবটা বোঝাই বন্ধুত্বের সবচেয়ে গভীর সম্পর্ক।

সারা জীবনে আমরা এমন অনেক মানুষের সংস্পর্শেই আসি যাদের সম্পর্কে এক ধরনের আত্মার বন্ধন অনুভব করি। এটাকে জাপানি ওই kenzoku শব্দের যোগ্য প্রকাশ বলতে পারি। সেটা হতে পারে মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা চাচাতো-মামাতো-খালাতো কিংবা ফুফাতো ভাই-বোন (এককথায় কাজিন)।   অথবা হতে পারে বাল্য বন্ধু, যাদের সঙ্গে দেখা বা কথা না হলে আমরা এক দণ্ডও থাকতে পারি না।

সময় কিংবা দূরত্ব যাই বলি না কেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা তাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বোধ করি না। হয়ত সময় বা জীবনের প্রয়োজনে প্রকাশ্যে একটা দূরত্ব আসতে পারে, কিন্তু অন্তরাত্মার এই আত্মীয়দের কাছ থেকে কি আদৌ দূরে সরে যাওয়া সম্ভব!

প্রশ্ন আসতেই পারে, পৃথিবীতে এতো মানুষ থাকতে কেন আমরা নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য এ ধরনের টান অনুভব করি! যদিও এর সব ব্যখ্যা কখনোই দেওয়া সম্ভব নয়, তবু এমন কিছুতো অবশ্যই আছে, যা আমাদের kenzoku  শব্দটার মানে বুঝতে সাহায্য করবে...

বন্ধুত্ব মানে অনুভব, বন্ধুত্ব মানে একে অন্যের পাশে পাশে থাকা। কিন্তু ঠিক কোন কারণে বা কেন মানুষ বন্ধু রূপে একে অন্যের পাশে থাকে?

এর কারণগুলো হলো-

অভিন্ন পছন্দ: এটা মানতেই হবে যে, অভিন্ন পছন্দের বিষয়টি একটা মানুষকে অন্য একটা মানুষের কাছাকাছি আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি তাদের পছন্দের বিষয়ে মিল না থাকে বা একইসঙ্গে কোনো কিছু উপভোগই না করে, সময়টা যদি খুব বিরক্তিকর এবং একঘেঁয়ে হয়ে যায়, তবে দেখা ‍যাবে তাদের সম্পর্কটা আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না। যদি পছন্দের বিষয়টি অভিন্ন না হয় তাহলে বন্ধুত্বের যে সাধারণ কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে, যা একটি সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে, সে বিষয়গুলোকে ধরে রাখা সম্ভব নয় ।     

কিন্তু এমনটিও হয় যখন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কোনো একজন একতরফা চেষ্টা বা যোগাযোগ  টিকিয়ে রাখে। কিন্তু এদের সংখ্যা খুবই কম।  

ইতিহাস: ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, মান‍ুষ যখন দীর্ঘসময় কোনো জটিল সমস্যার ভেতর দিয়ে যায়, তখন বন্ধুদের মধ্যে যত সূক্ষ্ম বিষয়েই মিল থাক না কেন, একসঙ্গে শেষ পর্যন্ত তাদের সে বিষয়গুলোও বেধে রাখতে পারবে না। এমনকি যে আত্মিক বন্ধন দুই বন্ধুকে এক সঙ্গে বেঁধে রাখতে সাহায্য করে, সে বিষয়গুলোও শেষ পর্যন্ত শুষ্ক হয়ে যায়, ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। বলা যায় সম্পর্ক চরমভাবে ব্যর্থ হয়, সম্পর্কের মৃত্যু হয়।

প্রচলিত মূল্যবোধ:  শুধুমাত্র বন্ধুত্ব তৈরি করাটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। নৈতিক মূল্যবোধটাও গুরত্বপূর্ণ। মূল্যবোধ এক না হলে সেটা আপনাকে বিপথগামী করতে পারে। কথায় আছে না, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। আর তাই একটা বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে বা সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে মূল্যবোধ মিল থাকার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সমতা: যদি এক বন্ধু নিয়মিতভাবে অন্য বন্ধুর ওপর নির্ভশীল হয় এবং এতে যদি সে এক তরফা সুযোগ নিতে থাকে, তাহলে একটা সময় সে বন্ধুত্বের মধ্যে শিথিলতা আসবে। দেওয়ার চেয়ে নেওয়ার মনোভাব বেশি থাকলেই সে বন্ধুত্ব সুন্দর আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কটাই যদি প্রধান হয়ে দেখা দেয়, তবে কি তাকে সত্যিকারের বন্ধুত্ব বলা যাবে ?

ওপরের কথাগুলোর কারণে অনেকেই সত্যিকারের বন্ধুত্বের বিষয়ে দ্বিধায় পড়ে যাবেন যে, তাহলে কাকে সত্যিকারের বন্ধু ভাববো?

সুখের প্রতিশ্রুতি: আপনার সত্যিকারের বন্ধু আপনার বন্ধুত্ব পাওয়ার আগেই আপনার ভাল-মন্দ কিংবা ভালো লাগা, খারাপ লাগার দিকে লক্ষ্য রাখবে। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, তা হলো ‘good advice grates on the ear’। কিন্তু আপনি পছন্দ করবেন না বলে সত্যিকারের বন্ধু কোনো কিছু বলা থেকে বিরত থাকবে না। এমনকি বন্ধুত্বে ফাঁটল ধরতে পারে এমন আশঙ্কা থাকলেও তিনি সত্য উপদেশটি বা পরামর্শটি আপনাকে দেবেনই।

নীতিবোধ: আপনার একজন ভাল বন্ধু কখনো বন্ধুত্বের অযুহাতে নীতির  প্রশ্নে আপনাকে আপোস করতে বলবে না। সেটা যেকোনো অবস্থায়ই।

অনুপ্রেরক: আপনার প্রিয় বন্ধু সবসময় আপনাকে ভালো কাজে উৎসাহ দেবে। আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে পথ চলতে উৎসাহ দেবে। আপনি যদি কখনো কাজ করতে গিয়ে ক্ল‍ান্ত হয়ে যান, তবে সে এমন কিছু করতে চেষ্টা করবে, যাতে আপনি আবার নতুন করে প্রাণশক্তি খুঁজে পাবেন। ঘুরে দাঁড়াবার কারণ খুঁজে পাবেন।

তবে, এ ধরনের সম্পর্কের বাইরে আরও এক ধরনের সম্পর্ক থাকতে পারে, যা এ kenzoku খেকেও বেশি কিছু।   সেটা  অন্যরকম কিছু। যার কারণে তাদের মধ্যে রোমান্টিক ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। শত চেষ্টা করেও তাদের সে অবস্থা থেকে নড়ানো যায় না।

এ ধরনের মানুষ খুঁজে পাওয়া সহজ নয়, তবে যখন আপনি এ ধরনের মানুষ খুঁজে পাবেন, সেটাকে পরমাত্মীয় বলতে পারবেন। তারা আসলে ‍অমূল্য রত্নের মতো।

অনেকেই হয়ত ভাবছেন এতো যে কথা বলা হলো, কীভাবে খুঁজে পাব এমন বন্ধু! এটা সত্য যে, বন্ধুত্ব তৈরি করা যায় না, বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তবুও একজন ভাল বন্ধু খুঁজে পাওয়া বা নিজেকে একজন ভাল বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা খুব একটা কঠিন কাজ নিশ্চয় নয়।

আমরা সাধারণত নিজের চরিত্রের প্রতিফলন অন্যের মধ্যে দেখতে পছন্দ করি। আর বন্ধু হিসেবে এমন লোককেই বেছে নিই, যার মধ্যে আমরা নিজেকে দেখতে পাই।

কোনো বিষয়েই আমার একার ভাগ নেই তাতে অন্যদেরও ভাগ আছে।   শুধু একটি ভালো লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। নিজেকে যখন কোনো ভালো কাজে যুক্ত করবেন দেখবেন, কতো ভাল মানুষ আপনার চারপাশে ভিড় করবে। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো, আপনার বন্ধুত্ব প্রত্যাশী। তবে এটা বলা কখনোই ঠিক হবে না যে, আপনি ভালো কাজের লক্ষ্য স্থির করবেন কেবল ভালো বন্ধু পাবার আশায়। আপনি ভালো কাজ করবেন, আপনার নিজের প্রশান্তির জন্য। হয়ত এই কাজের সূত্র ধরেই আপনি সেই আত্মার আত্মীয়কে পেয়ে যাবেন!

আমার এমন বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে, আপনার?

মনোকথা’ আপনাদের পাতা। মনোরোগ নিয়ে যে কোনো মতামত ও আপনার সমস্যার কথা জানাতে পারেন আমাদের। আমরা পর্যায়ক্রমে অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনাদের প্রশ্নের জবাব জানিয়ে দেবো। আপনি চাইলে গোপন রাখা হবে আপনার নাম-পরিচয় এমনি কি ঠিকানাও।

প্রিয় পাঠক, আপনার সমস্যার কথা জানানোর সঙ্গে সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ, আপনার নাম, বয়স, কোথায় থাকেন, পারিবারিক কাঠামো এবং এজন্য কোনো চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না এ বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের জানান। শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই আপনার সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা জানানো সম্ভব হবে।

আপনার সমস্যা, মতামত বা পরামর্শ জানাতে আমাদের ই মেইল করুন[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
এসএটি/এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।