ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ

মো.জাফর সাদেক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৩
জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ

ঢাকা: ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের ব্যবসা সারা বিশ্বেই বেশ জমজমাট। ভেজাল ওষুধ বলতে বোঝায়, ওষুধে যা যা উপাদান থাকার কথা তা না থেকে অন্য কোন উপাদান থাকা বা কার্যকরী কোন উপাদান না থাকা।



পাশাপাশি নিম্নমানের ওষুধ বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট ওষুধে যে পরিমাণ ওষুধ থাকার কথা তার চাইতে কম পরিমাণ ওষুধ থাকা বা মান নিয়ন্ত্রণের যে শর্ত তা পূরণ না করা।

বিশ্বে কি পরিমাণ ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হয় তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হয় এর বাৎসরিক পরিমাণ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার  (১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা) যা অবৈধ বাণিজ্যের বিবেচনায় দ্বিতীয় (১ম মাদক)।

অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই সমস্যা প্রকট আকারে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি তা বিস্তৃত হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতেও। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত ওষুধের শতকরা ৫ ভাগ ভেজাল বা নিম্নমানের।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বে যত ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয় তার শতকরা ৩৫ ভাগ তৈরি হয় ভারতে যার বাৎসরিক বাজার মূল্য ৪০০০ কোটি রুপি (৬০০০ কোটি টাকা) এবং ভারতের মোট ওষুধের বাজারের যা শতকরা ২০ ভাগ। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শতকরা ২৩ ভাগ ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ নাইজেরিয়া। এই দেশটির মোট উৎপাদিত ওষুধের শতকরা ৪১ ভাগই ভেজাল বা নিম্নমানের। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ তাদের মোট উৎপাদিত ওষুধের শতকরা ১৫ ভাগ যার বাৎসরিক বাজার মূল্য ১৬০০ কোটি টাকা।

একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বাৎসরিক বিক্রি প্রায় ১০০০ কোটি টাকা যা মোট বিক্রির প্রায় শতকরা ১০ ভাগ।

দুর্নীতি, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা, ক্ষমতাসীনদের অর্থলিপ্সা, শক্ত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রভৃতির পাশপাশি প্রযুক্তিগত অসামর্থ্যতা, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ও অজ্ঞতা ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বিস্তারের প্রধান কারণ।

ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের সমস্যা অত্যন্ত গুরুত্ববহ কারণ এটি মানব স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষজ্ঞদের মতে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের প্রভাব মাদক, ম্যালেরিয়া, এইডস বা অস্ত্রের সহিংসতার চাইতে কোন অংশে কম নয়। ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের প্রধান সমস্যাগুলো নিচে তুলে ধরা হলো,

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সঃ এন্টিবায়োটিক একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেবন করতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রার চাইতে কম মাত্রায় এন্টিবায়োটিক সেবন করলে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুরা ঐ ওষুধের বিপরীতে ধ্বংস না হয়ে কৌশলী আচরণ করে বেঁচে থাকে অর্থাৎ ঐ চিকিৎসা তো কোন কাজেই আসে না বরং পরবর্তীতে ঐ জীবাণুকে ওষুধ সহনশীল করে তোলে। নিম্নমানের বা ভেজাল ওষুধে পরিমাণের তুলনায় কম মাত্রায় এন্টিবায়োটিক থাকায় জীবাণুরা প্রতিরোধী হয়ে উঠে অর্থাৎ এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। এ কারণে অতি সাধারণ রোগ নির্মূলে অনেক উচ্চ মাত্রার এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন নিম্নমানের বা ভেজাল ওষুধই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের একমাত্র কারণ নয় বরং তা অনেক কারণের একটি।

চিকিৎসায় ব্যর্থতা: ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ সেবনের আরেক সমস্যা হলো রোগ থেকে মুক্তি না পাওয়া।

ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধে প্রয়োজন মত উপাদান না থাকায় তা রোগ সারাতে ব্যর্থ হয় এবং রোগের তীব্রতা বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিশ্বে প্রতি বছর ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ সেবনে শুধু যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ায় প্রায় ৭ লক্ষ রোগী মারা যায় সুতরাং ভেজাল ওষুধ সেবনে মৃত মানুষের মোট সংখ্যা কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

বছর দশেক আগে চীনে ভেজাল ওষুধ সেবনে প্রায় ১ লক্ষ ৯২ হাজার রোগী মারা গিয়েছিলো অন্যদিকে নিম্নমানের ভ্যাকসিনের কারণে নাইজারে মারা গিয়েছিলো প্রায় ৩ হাজার রোগী।

বিষক্রিয়া: ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ সেবনে রোগীর শরীরে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা হতে পারে যার মধ্যে কিডনি বিকল হওয়া, দৃষ্টি শক্তি হারানো, ফুসফুসের অসমর্থতা এবং মৃত্যু উল্লেখযোগ্য।

নিকট অতীতে চীন থেকে আমদানিকৃত ভেজাল হেপারিন ব্যবহারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু কিংবা ভেজাল প্যারাসিটামলে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু ভেজাল ওষুধ ব্যবহারে বিষক্রিয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আর্থিক ক্ষতি: ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ সেবনের আরেকটি দিক হলো রোগীর আর্থিক ক্ষতি। কারণ রোগী পয়সা খরচ করে ওষুধ ব্যবহার সত্ত্বেও তার প্রাপ্য ফলাফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর সঙ্গে যোগ হচ্ছে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যা সারাতে গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়।

ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বন্ধ করা খুব একটা সহজ কাজ নয় কারণ এটি এখন আর কোন জাতি বা গোষ্ঠীর একক ব্যাপার নয় বরং আন্তর্জাতিক ইস্যু।

তাই জনস্বাস্থ্যের বিশাল হুমকি ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে সবাইকে সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক পরিচিতি: মোঃ আবু জাফর সাদেক, ফার্মাসিস্ট ও  সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজার, রেনাটা লিমিটেড, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।