ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

শিশু ও কিশোর মনোরোগ: ছেলেটা এতো অস্থির!

ডা. মো. সালেহ উদ্দীন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৩
শিশু ও কিশোর  মনোরোগ: ছেলেটা এতো অস্থির!

রাসেল অতিমাত্রায় অস্থির প্রকৃতির। সারাক্ষণ এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে, স্থিরতা বলতে সে কিছুই নেই।

খুবই  অমনোযোগী, কিছু বলা বা ভাবার আগেই একটা কিছু বলে বা করে বসে। গত বার্ষিক পরীক্ষায় ফলাফল একদম যাচ্ছে তাই। স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী সবার অভিযোগে আমরা অতিষ্ঠ।

রাসেলের মা কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। মা যখন কথা বলছেন তখন রাসেলের বাবা তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। কারণ ছেড়ে দিলেই সে তার অস্বাভাবিক চঞ্চলতায় সবাইকে অতিষ্ট করে ফেলবে।

আমরা বেশির ভাগই হয়ত ভাবছি বাচ্চারা এরকম দুষ্টুমি করেই থাকে। আর ছেলে হলে তো কথাই নেই। কিন্তু সব কিছুরই যেমন একটা পরিমিতি বোধ থাকে তেমনি বাচ্চাদের চঞ্চলতারও একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে। এই সীমা অতিক্রম করলেই তা রোগ হিসেবে বিবেচিত হবে।     

রোগটার নাম ADHD (Attention Deficit Hyperkinetic Disorder)। শিশুদের নানা ধরনের স্নায়ু বিকাশ বা বৃদ্ধিজনিত রোগের মধ্যে ADHD উল্লেখযোগ্য।

সাধারণত ৬-৭ বছর বয়সের আগে এ রোগ খুব একটা ধরা পরে না। শিশুদের এক তৃতীয়াংশের বাবা মায়েরা সন্তানের অতিমাত্রায় চঞ্চলতা বা অস্থিরতার অভিযোগ করেন। আর স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা ৫-২০% ছাত্র-ছাত্রীর অনুরূপ সমস্যার কথা বলে থাকেন। বিশ্বব্যাপী এ যাবৎ ১০২টি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের নীচে এ রোগের হার ৫%, স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬% এবং কিশোর বয়সে ৩%।

চঞ্চলতা বা অতি অস্থিরতা মানেই ADHD রোগাক্রান্ত এমনটা ভাবার কারণ নেই। কারণ বাচ্চা বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চঞ্চলতা একটি স্বাভাবিক আচরণ। যখন সুনির্দিষ্টভাবে মনোযোগ, অস্থিরতা, চঞ্চলতা সংক্রান্ত কিছু উপসর্গ ৬ মাস বা তার বেশি সময় ধরে থাকে এবং এ সমস্যাগুলো বাচ্চার নিজের, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা স্কুলের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করে তবে চিকিৎসকরা বিষয়টিকে রোগপ্রসূত বলে ধারণা করে থাকেন। সাধারণত ১২ বছর বয়সের আগেই উপসর্গগুলো দেখা দেয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো-

মনোযোগ সংক্রান্ত: কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা বা প্রায়শই স্কুলের বা অন্যান্য কাজে অসাবধানতাবশত ভুল করে ফেলা, মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, কারো কোনো আদেশ না মানা কিংবা আদেশ মেনে একটা কাজ শেষ পর্যন্ত করতে না পারা, গুছিয়ে কোনো কাজ করতে না পারা, যেসব কাজে মনোসংযোগ আবশ্যক সেগুলো এড়িয়ে চলা, প্রায়ই জিনিস হারিয়ে ফেলা (পেন্সিল, রাবার, বই,  চশমা), দৈনন্দিন করণীয় কাজ করতে ভুলে যাওয়া ইত্যাদি।

চঞ্চলতা সংক্রান্ত: অস্থিরভাবে হাত পা ছোড়াছুড়ি করা বা নাড়ানো, প্রায়ই বসার জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া, হঠাৎ করে প্রয়োজন ছাড়াই দৌড় বা লাফ দেওয়া, অবসরে খেলা বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে না পারা, বেশি কথা বলা, প্রশ্ন করার আগেই মুখ ফসকে উত্তর বলা, লাইনে একজনের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করে আগেই চলে যাওয়া ইত্যাদি।
 
রোগের কারণ
ঠিক কি কারণে এ রোগ  হয় তা এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা যায়নি। তবে নানা গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে মস্তিষ্কের যে সমস্ত অংশ (ফ্রন্টাল কর্টেক্স, বেসাল গেংলিয়া, সেরিবেলাম) মানুষের মনোযোগ, স্থিরতা ইত্যাদি আত্মনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে  তাদের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা এক্ষেত্রে মূল কারণ। আর এ সমন্বয়হীনতার ক্ষেত্রে কিছু জেনেটিক কারণ রয়েছে। পরিবেশগত কিছু ঝুঁকির কথা বলা হলেও রোগের সৃষ্টিতে তাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই।
 
এ রোগের ভবিষ্যৎ
সাধারণত বয়স বাড়ার  সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যাগুলো কমতে থাকে এবং বয়ঃসন্ধিকালের  দিকে আর থাকে না। তবে ৫০% ক্ষেত্রে কৈশোরকাল পর্যন্ত  সমস্যাগুলো রয়েই যায়।   প্রাপ্ত  বয়স্ক অবস্থায় অতি চঞ্চলতা বা অস্থিরতা ইত্যদি উপসর্গ না থাকলেও বিগত দিনের সমস্যার  কারণে তার দৈনন্দিন কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।

সমাধান
সাইকোলজিকাল (বিহেভিয়রাল থেরাপি) এবং ঔষধ এ দুই উপায়ে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়। বাচ্চার পরিবারের ও স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষকদের উক্ত রোগ সম্পর্কিত ধারণা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাচ্চার অনিচ্ছাকৃত অতি চঞ্চলতা, অস্থিরতা বা অমনোযোগিতার পেছনে ADHD দায়ী। এক্ষেত্রে সবার সহানুভূতিশীল আচরণ বাচ্চার সেরে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। অষুধের মধ্যে মিথাইল ফেনিডেট, ডেক্সঅ্যাম্ফিটামিন, এটোমক্সেটিন উল্লেখযোগ্য।
 
আবারও ফিরে আসি রাসেল প্রসঙ্গে। অন্য বাচ্চাদের  মতো রাসেলও প্রকৃতির সন্তান। তার আপাত অতি দুরন্তপনাই তার রোগের কারণ। বিকাশজনিত সমস্যার কারণে সে চাইলেও স্থির থাকতে পারে না। মনোযোগের অভাবে স্কুলের পড়াগুলো তার শেখা হয়ে ওঠে না। সবার কাছে সে বিরক্তির নামান্তর। কাজেই অতিমাত্রায় অস্থিরতা বা চঞ্চলতা বা অমনোযোগিতার জন্য নেতিবাচক মনোভাব না দেখিয়ে তার আড়লে ADHD আছে কিনা তা সবার ভাবা উচিৎ ।
 

আপনাদের মতামত এবং সমস্যার কথা জানিয়ে আমাদের ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।

ডা. মো. সালেহ উদ্দীন
এম  ডি , ফেইজ এ (সাইকিয়েট্রি)
ডিপার্টমেন্ট  অফ সাইকিয়েট্রি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad
welcome-ad