ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

মানসিক রোগে শারীরিক সমস্যা!

ডা. পঞ্চানন আচার্য্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৩
মানসিক রোগে শারীরিক সমস্যা!

কামরুল সাহেব অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। দিনে দিনে নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে।

শুরুটা বছর তিনেক আগে মাথাব্যথা দিয়ে । প্রথমে অল্প অল্পই হতো। বাড়তে বাড়তে তা এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে।

মাথাব্যথা দিয়ে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে চোখে ঝাপসা দেখা, হাঁটুতে ব্যথা, পেটে অস্বস্তি থেকে শুরু করে শতেক সমস্যা। চোখের ঘুম হারাম। সারাদিন অসুখ নিয়েই চিন্তা।

1m2প্রথমে নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেতেন, তারপর ওষুধের দোকানদার, এল.এম.এ.এফ, স্থানীয় এম.বি.বি.এস ডাক্তার, শহরের বড় প্রফেসর- অনেককেই দেখিয়েছেন। শুধু অ্যালোপ্যাথি নয়, সবধরনের চিকিৎসাই নেওয়া হয়ে গেছে।

প্রথম কিছুদিন ভালো, তারপর আবার সেই একই দশা। বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা দেখেন, টেস্ট করান একগাদা, শেষে বলেন আপনার তো কোনো সমস্যা নাই; তাও কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি খেয়ে দেখেন, আশা করি ভালো লাগবে।

ভাল তো আর লাগে না, কামরুল সাহেবও আর তাদের কাছে যান না। একবার গিয়েছিলেন-আর সেই ডাক্তার উপদেশ দিল মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে। শুনে এমন রাগ হলো- রোগ ধরতে পারে না, রোগী ভাল করতে পারে না, উল্টো রোগীকে বলে পাগল!

সেই থেকে একের পর এক ডাক্তার দেখিয়েই চলেছেন- ডাকটিকিটের মতো হাজারো প্রেসক্রিপশনের সংগ্রহ তৈরি হয়েছে, ডাক্তার-চেম্বার-ওষুধের নামের জীবন্ত অভিধান হয়ে গেছেন। কিন্তু ভাল আর হতে পারলেন না। বন্ধু-বান্ধবরা পরামর্শ দিলেন- বাংলাদেশে আবার চিকিৎসা হয় নাকি, দেশের বাইরে যাও। টাকা বেশি থাকলে সিঙ্গাপুরই যেতেন, তা যখন হচ্ছে না- তখন ভারতেই যাবেন। তবে দেশে শেষ চেষ্টা হিসেবে দেশের একমাত্র মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন এক বেয়াইয়ের পরামর্শে। 2m20

বহির্বিভাগের বারান্দায় বসে আছেন ডাক্তারের জন্য। কথায় কথায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়। তার কাছ থেকে শুনলেন অনেকটা তার মতোই কাহিনী।

ভদ্রলোকের ছিল পেটের গণ্ডগোল। ডাক্তারের কাছে গেলে বলা হয় এটা এক ধরনের মানসিক সমস্যা। একমাস ওষুধ খেয়ে এখন বেশ ভাল আছেন, দ্বিতীয়বার দেখাতে এসেছেন। ভদ্রলোকটিও প্রথমে মানতে চাননি ডাক্তারদের কথা, তবে এখন অনেক ভাল লাগছে - তাই বুঝতে পারছেন কথাটা সত্যি।

এই প্রথম কামরুল সাহেবের মনে নিজের ভাবনার উপর সংশয় এলো। তবে কি তিনি এতদিন ভুল করেছেন?

লেখাটা গল্পের মতো শোনালেও নামটা বাদে আর সবই সত্যি। প্রমাণ হিসেবে আপনার আশপাশে এরকম দু’একজন পেয়েও যেতে পারেন। হয়তো ভাবছেন - তবে কি এসব রোগীর আসলেই কোনো সমস্যা নেই? সবকিছুই কি মানসিক?

রোগটা মানসিক, কিন্তু যন্ত্রণা শারীরিক! অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের ‘মিসির আলী’ টাইপ রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আসলে ব্যাপারটা কি?  তাহলে চলুন, কিছু সাধারণ কথা জেনে নেওয়া যাক।

আমরা প্রায় সবাই ‘মন’ এবং ‘শরীর’কে দুইটি আলাদা ব্যাপার ভাবতে অভ্যস্ত হলেও, এরা যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ। আবার শারীরিক অসুবিধার কারণে মন খারাপ হওয়াও আমাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। অতএব, মনের কারণে যে শারীরিক অসুবিধা হতে পারে তাতে আর কি সন্দেহ! সমস্যা হয় তখনি, যখন কেউ বলে এই যে আমার এত শারীরিক কষ্ট, যার জন্য এক দুর্বিষহ জীবন আমি ভোগ করছি, তার কারণ আসলে মানসিক! শুনতেই মনে হয় যেন সব ইচ্ছে করেই করছি, সবাই ব্যাপারটা গুরুত্বহীন ভাবছে, কিংবা আমাকে ভণ্ড ভাবছে।

আসলে বিষয়টা সেরকম নয়।  

চিকিৎসা শাস্ত্রে এর আলাদা একটা নাম আছে। ইংরেজিতে বললে, Somatic Symptom Disorder. আক্ষরিক অনুবাদ না করে সহজভাবে বলা চলে ‘শারীরিক অসুবিধা সম্পর্কিত অসুস্থতা’।

এক্ষেত্রে, এক বা একাধিক উপসর্গ থাকতে পারে। এসব উপসর্গের অন্য কোনো রোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকা না থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এসবের কারণে রোগীর অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করা, এমনকি বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজেও ক্রমাগত ক্ষতি হওয়া। মোটকথা, রোগীর কষ্টটাই আসল।

4m2সেই সঙ্গে রোগীরা এসব উপসর্গ নিয়ে বা তার স্বাস্থ্য নিয়ে সারাক্ষণ অতিমাত্রায় ভাবতে থাকে, খুবই দুশ্চিন্তা করতে থাকে। দিনের বেশিরভাগ সময় এই কাজেই ব্যয় হয়ে যায়। তারা অহেতুক উদ্বিগ্ন হয়। উপসর্গগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করতে থাকে।

অনেকে এমনকি ভালোভাবে বুঝানো সত্ত্বেও যুক্তিহীনভাবে খুব খারাপ কিছু হয়ে গেছে ভেবে ভয় পেতে থাকেন। ফলস্বরূপ তার আচার-আচরণ থেকে শুরু করে অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক- সব কিছুতেই পরিবর্তন হতে থাকে, যা অন্যরা ঠিকই বুঝতে পারে।

এ ধরণের রোগীদের ক্ষেত্রে তাই একই সমস্যার জন্য একসাথে অনেক ডাক্তারকে দেখানো, জোর করে এমনকি কারো পরামর্শ ছাড়া নিজ উদ্যোগে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর কেউ যদি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলে তবে প্রায় ক্ষেত্রেই খুব অবাক হয়ে যায় অথবা সরাসরি অমত করে, অনেকে রেগেও যায়।

তবে রোগ হিসেবে বলতে গেলে এসবের স্থায়িত্ব ৬ মাসের বেশি হতে হবে।

উপসর্গগুলো সুনির্দিষ্ট হতেও পারে (যেমন মাথাব্যথা), আবার নাও হতে পারে (যেমন শারীরিক দুর্বলতা)। উপসর্গগুলি হয় বিচিত্র রকমের- ব্যথা, ক্লান্তি, বমিভাব, বমি, পেটে অস্বস্তি, হাত পা অবশ লাগা, দুর্বলতা, চোখে ঝাপসা দেখা, কানে শব্দ হওয়া, গলায় কিছু আটকে থাকার অনুভূতি, শ্বাসকষ্ট,  হাতের তালু-পায়ের তালুতে জ্বালা-পোড়া অনুভূতি- এক কথায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেকোনো জায়গায় যেকোনো অসুবিধা। সবকিছু বলতে গেলে অনেকটা ‘আলসার থেকে ক্যান্সার’-এর সস্তা ওষুধ বিক্রেতার কথার মতোই শোনাবে।

তবে, উপসর্গ হিসেবে ব্যথার অবস্থান সবার প্রথমে। আবার অল্পবয়সীদের বেশি হয় পেটে ব্যথা, নারীদের ক্ষেত্রে বেশি হয় তলপেটে ব্যথা।

বলা হয়ে থাকে, এ রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে- নারী, বৃদ্ধ, নিম্নবিত্ত, বেকার, সমস্যা-পূর্ণ শৈশব ইতিহাস, যৌন নিগ্রহের শিকার, কোনো দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক বা মানসিক রোগাক্রান্ত, সামাজিক চাপের শিকার ব্যক্তিদের। এছাড়াও, যে সব ব্যক্তি হতাশাবাদী বা নিজ জীবনের খারাপ দিকগুলো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে তাদের মধ্যেও এই রোগের সম্ভাবনা বেশি।

5m20সমস্যা নিয়ে তো অনেক কথাই হল, এবার সমাধানের কথায় আসি।

সমাধানের ব্যাপারে চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক কিছুই বলা আছে, তবে সে সব গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনায় মাথা ঘামানোর দরকার নেই। দরকার রোগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ জানা, জানার মাধ্যমে সচেতন হওয়া, সচেতন হওয়ার মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা।

রোগটা নিজেরই হোক অথবা ঘনিষ্ঠ কারো- শারীরিক অসুবিধা বা বিভিন্ন উপসর্গ মাত্রই যে মানসিক রোগ নয়- এটা জানা যেমন জরুরি, তেমনি মানসিক রোগের কারণে শারীরিক অসুবিধা দেখা দিলে সেটা স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার মানসিকতা বা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলাও জরুরি। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে কুণ্ঠা বোধ না করাটাও এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেবল তখনই কমবে ভোগান্তি, বাঁচবে জীবনের মূল্যবান সময় আর দেখা মিলবে মানসিক শান্তির।  

আপনাদের মতামত এবং সমস্যার কথা জানিয়ে আমাদের ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।

ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
এম ডি (সাইকিয়াট্রি) ফেইজ-এ রেসিডেন্ট
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ,  বি.এস.এম.এম.ইউ

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৩
এসএটি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।