‘আমি এখন কি করবো?’ প্রশ্নটা কাকে করবেন? মনোরোগবিদ বা সাইকিয়েট্রিস্ট নাকি মনস্তত্ত্ববিদ বা সাইকোলজিস্টকে।
দু’মুঠো খাবার যোগাড় যেখানে নিত্য সংগ্রাম, সেখানে মন কিংবা মনোরোগ বিষয়টা বলতে গেলে একটি নির্মম কৌতুক।
গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকে এখনো এ ধরনের কোনো রোগ আছে বলে মনে করেন না। তাদের কাছে অস্বাভাবিক কোনো আচরণ আলগায় ধরা, জিনের আছর, তাবিজ করা কিংবা তুক-তাক করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আরো অবাক করা বিষয় হলো শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর, এমনকি চিকিৎসকদের মাঝেও ‘মনোরোগবিদ’ এবং ‘মনস্তত্ত্ববিদ’র কর্মপরিধি সম্পর্কিত অজ্ঞতা লক্ষণীয়।
মনোরোগবিদ বা সাইকিয়েট্রিস্ট
মনোরোগবিদ বা সাইকিয়েট্রিস্ট আসলে একজন চিকিৎসক যিনি এম বি বি এস পাশ করার পর এম ফিল, এম ডি বা এফ সি পি এস ডিগ্রি অর্জন করেন। আর এ ডিগ্রি অর্জনের ফলে তিনি মনোরোগ সনাক্তকরণ, চিকিৎসার মূল পদ্ধতি নির্ধারণ ও মনোরোগগ্রস্ত ব্যক্তির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ফলপ্রসূ চিকিৎসা পদ্ধতি বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করেন।
প্রাত্যহিক জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের নানা ধাপে একজন সুস্থ স্বাভাবিক রোগহীন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি বা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। হয়তো হাসি-কান্না, ক্রোধ, চিৎকার, বিমর্ষতা, আগ্রাসী আচরণ ইত্যাদি।
কোনো ব্যক্তিকে ধরেবেধে নিয়ে আসলেই এটা প্রমাণিত হয় না যে, তিনি মানসিক রোগী। কিংবা আপাত সুস্থ প্রতিয়মান ব্যক্তির যে মানসিক রোগ নেই এমনটাও দাবি করা যাবে না।
এক্ষেত্রে মনোরোগবিদ গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যে, ব্যক্তির ওই সমস্যাগুলোর মূলে কোনো মানসিক রোগ আছে কি না। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন উক্ত চিকিৎসাপ্রার্থী ব্যক্তির ব্যক্তিগত, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট। কেননা কাউকে মানসিক রোগী হিসেবে সাব্যস্ত করে কিংবা নিজেই রোগী সেজে সামাজিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা শুধুমাত্র দরিদ্র দেশগুলোতে নয়, সারা বিশ্বে একটি প্রচলিত রীতি।
এক্ষেত্রে মনোরোগ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যাদি জানার পাশাপাশি মনোরোগবিদরা খুব যৌক্তিক কারণেই মানব মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন।
মনস্তত্ত্ববিদ বা সাইকোলজিস্ট
বাংলাদেশে বর্তমানে পাবলিক ও প্রাইভেট অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর উক্ত ছাত্র বা ছাত্রী একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে পরিচিত হন।
মনে রাখতে হবে সাইকোলজিস্ট বা মনস্তত্ত্ববিদরা কিন্তু চিকিৎসক নন। কাজেই কেউ যদি মনস্তত্ত্ববিদের কাছে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ চান, তবে তা ঐ ব্যক্তির অজ্ঞতারই প্রকাশ।
মনস্তত্ত্ববিদরা মূলত একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শৈশব থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের নানা ধাপে নানান প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশিত আচরণ বা অভিব্যক্তি কি হবে সে সম্পর্কে খুব স্বচ্ছ ধারণা রাখেন। দৈনন্দিন জীবনে তারা ব্যক্তির সক্ষমতা যেমন- রাগ দমন, আত্মবিশ্বাস, মনোভাব, চাপ সহ্য ক্ষমতা, মানুষের সঙ্গে মেশার দক্ষতাসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলে সে অনুযায়ী উক্ত ব্যক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা ধরণের সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা বা সাইকোথেরাপি প্রদান করেন।
সাধারণ মানুষের অনেকে মৌখিক পরামর্শের বা সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু সত্যি হচ্ছে সাইকোথেরাপি বা পরামর্শকেন্দ্রিক এ চিকিৎসা পদ্ধতি পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত।
উল্লেখ্য, মনোরোগগ্রস্ত ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণ সংশোধনের ক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে সাইকোলজিস্টরা মনোরোগসৃষ্ট অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখেন।
দু’জনের মধ্যে পার্থক্য
মনোরোগের চিকিৎসার দুটো অংশ থাকে। ফারমাকোলজিক্যাল ও সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট। ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসাকেই ফারমাকোলজিক্যাল চিকিৎসা এবং নানা পরামর্শ ও আচরণ অনুশীলনের সুসমন্বিত পদ্ধতিকে সাইকোথেরাপি/সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা বলে।
অনেকে আবার সাইকোথেরাপিকে ক্যন্সারের কেমোথেরাপির মতো ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা ভেবে ভুল করেন। মানসিক রোগের ওষুধ বিহীন সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসার অংশটুকু মূলত সাইকোলজিস্টের আওতাধীন বিষয়। এক্ষেত্রে সাইকিয়েট্রিস্ট সিদ্ধান্ত নেন কোন মানসিক রোগীর জন্য কোন সাইকোথেরাপি উপযুক্ত। সে অনুযায়ী সাইকোলজিস্ট তার কর্ম পরিচালনা করে থাকেন।
শেষ কথা
কে কোন বিদ্যায় বিদ্বান বা কোন তত্ত্বে পারদর্শী তাতে সাধারণ মানুষের খুব একটা আগ্রহ নেই। ‘তিনি বা তারা এখন কি করবেন?’ সে প্রশ্নের উত্তরটাই তাদের কাছে মুখ্য। মনোরোগবিদ বা মনস্তত্ত্ববিদ এর কর্ম পরিধির মাঝে সুস্পষ্ট সীমানা আছে। সে অনুযায়ী স্ব অবস্থানে থেকে যুগপদভাবে রোগীর রোগ নিরাময় প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ।
মনের রোগ, মনোরোগবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ একই সুতোয় গাঁথা। তাদের গন্তব্য এক ও অভিন্ন। আর তা হলো সুস্থ-স্বাভাবিক মন।
আপনাদের মতামত এবং সমস্যার কথা জানিয়ে আমাদের ই মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।
ডা. মো. সালেহ উদ্দীন
এম ডি , ফেইজ এ (সাইকিয়েট্রি)
ডিপার্টমেন্ট অফ সাইকিয়েট্রি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৩
এসএটি/এডিবি