ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

আমি কি ছোট্ট আছি, না বড় হয়ে গেছি!

ডা. সৃজনী আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৩
আমি কি ছোট্ট আছি, না বড় হয়ে গেছি!

১২ বছরের সোমা খুব অবাক হয়ে গেল মায়ের কথা শুনে। বাইরে বের হওয়ার সময় সোমা কোন জামাটা পড়বে তা নিয়ে মা বললেন, ‘তুমি এখনো ছোট, আমি যা বলবো, যেভাবে বলব সেভাবে চলবে।



আবার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে মা বলেন, ‘এত বড় হয়ে গেলে, কবে যে তোমার বুদ্ধি হবে?’ মায়ের এ দুই রকম মন্তব্য সোমার মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিল।

রবীন্দ্রনাথ এ সময়টা সম্পর্কেই বলেছেন, ‘১৩-১৪ বছরের মতো বালাই আর নেই’।   এ বয়সে নিজেকে যেন কোথাও খাপ খাওয়ানো যায় না। নিজের কি মনে হয়, কিভাবে চলতে ইচ্ছে করে এবয়সী ছেলে-মেয়েরা বোধয় তা নিজেও জানে না। এমনকি নিজেকেই যেন নিজের কাছে ভীষণ অচেনা মনে হয় তাদের।    

মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ হচ্ছে কৈশর। এই সময়টা সাধারণত ১১-১২ বছর বয়স থেকে ১৮-১৯ বছর বয়স পর্যন্ত। এ পর্যায়টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লিঙ্গ অনুযায়ী শারীরিক পরিবর্তন।

বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই পরিবর্তনের ধাপটিকে বয়ঃসন্ধি বলা হয়। বিভিন্ন হরমোন, জীনগত বৈশিষ্ট্য, পুষ্টি, পরিবেশের অবস্থা অনুযায়ী ব্যক্তিভেদে এই শারীরিক পরিবর্তনগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
 
শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক জগতেও এই সময়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে। শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, নিজের ভূমিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নতুন ভাবে সম্পর্কের হিসেব-নিকেশ তৈরি হওয়া, লেখাপড়া এবং অন্যান্য গুণাবলির ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করা, নৈতিকতার বিকাশ ইত্যাদি বিষয়ে এই সময়টা মানসিক জগতের বিকাশের একটি মাইলফলকের মতো কাজ করে। কৈশোরকালীন এই সময়টাতে মানসিক জগতে সংকট তৈরি হতে পারে, আবার সুন্দর ভাবেও পার হতে পারে।  

শারীরিক পরিবর্তনগুলোর ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে ভয় তৈরি হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ভুল ধারণাও তৈরি হয়। এছাড়া অনেক সময় এই পরিবর্তনের সূচনাগুলো অহেতুক ভীতিরও জন্ম দেয়।

শিশুর মতো নিজের প্রাত্যহিক চাহিদাগুলোর জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকেনা এ বয়সী ছেলে-মেয়েরা। নিজের পছন্দকে প্রকাশ এবং পালন করতে চায়। সর্বোপরি নিজেকে আলাদা একজন মানুষ হিসেবে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়।

পরিবারের মধ্যে নিজের অবস্থান খুঁজে পেতে এ বয়সীরা সচেষ্ট থাকে। নিজের মতামত প্রকাশের প্রবণতা দেখা দেয়, সরাসরি বাধা পেলে বিরূপ মানসিকতা তৈরি হয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের বোধ এই বয়সে উপলব্ধিতে আসতে থাকে।

সামাজিক ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সময়। ব্যক্তিগত নীতি নৈতিকতার সংজ্ঞা তৈরি হয় এই বয়সেই। পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশ অনুযায়ী মূল্যবোধের চর্চা শুরু হয়।

এ বয়সের মানসিক স্বাস্থ্য অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। পূর্বে যেমন বলা হয়েছে যে শারীরিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে অহেতুক ভীতি তৈরি হতে পারে, এমন কি স্বাভাবিক বিষয়গুলো নিয়ে অপরাধ বোধও দেখা যায়।

পরিবারে মা-বাবার আচরণ, পরিবারে নিজের মূল্য পাওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ এই বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এছাড়া এ সময়টাতে বন্ধু বা সমবয়সী সদস্যদের সঙ্গে বোঝাপড়াটা অন্য মাত্রা নেয়। মা- বাবা অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় বন্ধুকে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়।

বন্ধুদের প্রভাব ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক দুইরকমই হতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলবদ্ধভাবে একটি কার্যক্রম পরিচালনায় যেমন বন্ধুর প্রভাব থাকতে পারে আবার মাদক গ্রহণেও বন্ধুর প্রভাব থাকতে পারে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য এখনো অনেকখানি উপেক্ষিত এবং ঝুঁকির মুখে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে বাল্যবিবাহ, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে কিশোর-কিশোরীদের অংশগ্রহণ তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। আবার সামাজিকভাবেও কৈশোরকালীন মানসিক পরিবর্তন এবং যথাযথ পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত।

এই ধাপটিতে মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা ভবিষ্যতের সুনাগরিক তৈরির হাতিয়ার।

ডা. সৃজনী আহমেদ
এম ডি, ফেজ এ মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বি এস এম এম ইউ
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬ , ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।