ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগে মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা

আবুল হাসেম খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১১ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৩
দুর্যোগে মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল- কথাটি সর্বজনবিদিত। সাধারণভাবে স্বাস্থ্য বলতে আমরা দেহের গড়ন হালকা, মাঝারি, মোটা ইত্যাদি বিবেচনা না করে নিরোগ দেহকে বুঝি।

আমাদের প্রচলিত এই একপেশে ধারণায় মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটিকে বিবেচনায় আনা হয় না।

কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্য বিষয়ক সামগ্রিক ধারণাটি হচ্ছে-  শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য। তাই আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা আবশ্যক। monokotha

আর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এ বিষয়ে পড়াশোনা করা যায়-
-  বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগে
-  মেডিকেল কলেজে সাইক্রিয়াটিক বিষয়ে
-  জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় নিরাময়ী নাট্যক্রিয়া (প্লেবেক থিয়েটার, সাইকোড্রামা, সোসিওড্রামা) এর নানা অনুসঙ্গ বিষয়ে।

‘২৩ জুলাইকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ঘোষণা’ সুশীল সমাজের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়ায় আমাদের দেশে মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি হয়নি।

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনটি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কাজের অগ্রাধিকারের তালিকায় সবার নিচে থাকার কারণে মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অতি প্রয়োজনীয় এই আইনটি পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়ে সমাজে কার্যকারিতা লাভ করতে পারছে না।

এসব কারণে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলে স্থানীয় হাসপাতালে সহজলভ্য কোনো চিকিৎসা সহায়তা পাওয়া যায়না। আর এ বিষয়ে অসচেতনতার কারণে আমরা মানুষের এই সমস্যাটিকে আমরা গভীরভাবে ভেবে দেখিনা। কোনো কারণে মনোসামাজিক সমস্যা হলে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের গতি ব্যাহত হয়। সমস্যার মাত্রা একটু বেশি হলে গোটা পরিবারটির আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুবই নাজুক পর্যায়ে নেমে আসে। monokotha

দুর্যোগ প্রবন বাংলাদেশে ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছাসে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। কোনো কোনো সময় সিডর-আইলা-টর্নেডো’র আঘাতে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়ে মানুষকে চরম মাত্রায় মনোসামাজিক সমস্যাগ্রস্ত হতে দেখেছি আমরা। ভয়াল আকারে সংগঠিত এসব দুর্যোগে আর্থিক, পুনর্বাসন, অবকাঠামো নির্মানের সহায়তার পাশাপাশি মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রদান জরুরি হয়ে পড়ে। দাতা সংস্থা একশন এইড’র সহায়তায় সিডরের আঘাতে স্বজন হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে উৎস (UTSA) থিয়েটার থেরাপিস্টিদের সফলতার কথাও আমরা জানি।

২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাই উপজেলার আবুতোরাব এলাকায় ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। একটি ছোট পরিসরের এলাকায় এত শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে এক ভয়াবহ শোকার্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থা আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মনোসামাজিক পরিচর্যা দিতে এগিয়ে আসে। এ দুর্যোগে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুফল আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।  

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উৎস’র (UTSA) সহযোগীতায় ২০১১ সালের ১ থেকে ১১ অক্টোবর মার্ক এবং ফিলিপ আবুতোরাব এলাকায় অবস্থান করে মনোবিশ্লেষক নাট্যযজ্ঞ’র কৌশল ব্যবহার করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীসহ শোকাহত স্বজনদের মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রদান করে। এর ফলে এলাকার সব স্তরের মানুষের মনে শোককে শক্তিতে রূপান্তর করার মনোবল গড়ে ওঠে। ফুটবল নিয়ে মানুষের মনে সৃষ্ট ভীতি দূর করতে সক্ষম হন। আবুতোরাব স্কুল মাঠে সবাই মিলে ফুটবল খেলার আয়োজন করেন।
monokotha
২০১২ সালের ১২ থেকে ২০ মার্চ জেনি ক্রিস্টালের নেতৃত্বে উৎস’র থিয়েটার থেরাপিস্টদের নিয়ে প্লেব্যাক থিয়েটারের নানা অনুসঙ্গ ব্যবহার করে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর ফলে শোকার্ত মানুষের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং তারা নতুন উদ্যম নিয়ে নিজেদের জীবনমান উন্নয়নের কাজে অধিকতর মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়।

পরপর দুইবার স্বল্পমেয়াদী সময়ে উৎস’র পরিচালনায় মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এলাকার মানুষের মাঝে একটি ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়। সার্বিকভাবে আবুতোরাব এলাকার শোকার্ত মানুষদের মাঝে সরকারের উদ্যেগে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তাদের মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রদান করা একান্তভাবে প্রয়োজন রয়েছে।

মনোসামাজিক পরিচর্যার এ সকল ইতিবাচক উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে অদৃশ্যপূর্ব সাভার ট্রাজেডিতে সৃষ্ট ভয়াবহ শোকাবহ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা, আর্থিক, পুনর্বাসন সেবার পাশাপাশি মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সেবা প্রদান করা জরুরি।

বেঁচে আসা মানুষের মৃত্যুপুরীর ভয়াল স্মৃতির কারণে সৃষ্ট মনোসামাজিক সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাঝে যোগাযোগ ও সমন্বয় গড়ে তোলা প্রয়োজন।

সাভার ট্রাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের পাশে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহের নেওয়া চিকিৎসা, আর্থিক, পুনর্বাসন কার্যক্রমের পাশাপাশি মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সেবা প্রদান এর পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। তা না করলে সামগ্রিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কাজ ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। monokotha

সাভার ট্রাজিডিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৫টি গার্মেন্টসে নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিক, আহত শ্রমিকদের মধ্যে যারা অঙ্গহানীর কারণে প্রতিবন্ধি হয়েছেন, মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে আসা শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের পরিকল্পিতভাবে  মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সেবা প্রদান কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ ভয়াবহ এই বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পরেছেন। তাদের এই ক্ষতি কোনোভাবেই প‍ূরণ হবার নয়।

উৎস ২০০৩ সাল থেকে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সেবা প্রদান বিষয়টিকে সরকার ও জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিদেশি মনোবিশ্লেষক প্রশিক্ষক এনে কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। এভাবে দক্ষ থিয়েটার থেরাপিস্ট গড়ে তুলে নতুন একটি ধারা বিকাশ করছে। কিন্তু আমাদের দেশে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ না হওয়া এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা না থাকায় বিষয়টি মানুষের অতি প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও সমাজে এখনো তা প্রতিষ্ঠালাভ করেনি।
monokotha
আশার কথা ডিজঅ্যাবিলিটি রাইটস ফান্ড (ডিআরএফ), ডিয়াকোনিয়াসহ বেশকিছু দাতা সংস্থা ইতোমধ্যে এই বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে অর্থায়ন শুরু করেছে। পাশাপাশি সরকারি- বেসরকারি সহায়তা পেলে কার্যক্রম গতিশীল হলে তা জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেহের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মনের স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করতে জনসচেতনতা বাড়াতে এখনি উদ্যোগ নেওয়া দরকার। দুর্যোগে নাকাল মানুষের মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়টিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সাভার ট্রাজেডিতে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দ্রুত সাড়া দেবেন বলে আমরা আশাবাদী।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে উৎস (UTSA) বিগত ২৭ মে থেকে ০৩ জুন, ২০১৩ পর্যন্ত একটানা সপ্তাহব্যাপী প্রাথমিক মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্পের আয়োজন করে সাভার ট্র্যাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির বিপর্যয়ের ধরণ নিরুপনের জন্য।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে বিনামূল্যে এই সেবা প্রদানের মাধ্যমে দুর্ঘটনাপরবর্তী তাদের মধ্যেকার সৃষ্ট আতঙ্কগ্রস্ততা, ভীতি, দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠাসহ নানা মানসিক সমস্যা দূর করা সম্ভব হয়। নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট, হতাশা, অনিশ্চয়তাকে পিছনে ফেলে উন্নত নৈতিক মনোবল নিয়ে তারা এখন সামনের প্রতিকূলতাগুলোকে কাটিয়ে জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছে।

আবুল হাসেম খান
প্রোগ্রাম অর্গানাইজার, উৎস, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।