ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগ ও মানুষ: মানসিক সমস্যা

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৭ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৩
দুর্যোগ ও মানুষ:  মানসিক সমস্যা

বাংলাদেশের ইতিহাসেতো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও এক ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয় সাভার ট্র্যাজেডি। যারা নিহত হয়েছেন তারা বেঁচে গেছেন একভাবে।

আর যারা জীবিত ফিরেছেন সুস্থ -স্বাভাবিক ভাবে, কিংবা যারা হারিয়েছেন হাত-পা তারা বা তার আত্মীয়-পরিজন তারা কি আর কখনো সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন? নাকি এ ভবন ধসের ভয়াবহতা সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে তাদের!

শুধু হাত-পা বা শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারানোই নয় এ ভয়াবহ স্মৃতি তারা মানসিক ভাবেও বয়ে বেড়াতে পারেন সারা জীবন। কখনো কখনো এ স্মৃতি তাদের মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্তও করে তুলতে পারে। যুদ্ধ-বিগ্রহ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরবর্তী সময় দেখা দিকে পারে এ সমস্যা। অনেক সময় এ ধরনের মানুষ যুদ্ধ বা দুর্যোগ সম্পর্কিত কথা বা খবর এড়িয়ে চলতে শুরু করেন।       
Savar-12013
দুর্যোগে কি হয়?
শুধু সাভার নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই, শিল্প কারখানা, যানবাহন, জলবায়ু আর প্রকৃতির খেয়াল মর্জিতে হাজারো মানুষের হাজার রকমের দুর্ভোগ নিয়ে আসে অসংখ্য দুর্যোগ। একটি হিসেবে দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে গড়ে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনো দুর্যোগের কারণে ভুক্তভোগী।

শারীরিক আঘাততো অবশ্যই, শত শত লোক প্রতিবছর প্রাণও হারান এসব দুর্যোগের কারণে। যারা বেঁচে যান তারাও কম-বেশি পঙ্গুত্ব কিংবা ব্যথা-জরায় দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে তাদের ঘর-বাড়ি, কাজের জায়গা এমনকি উপার্যনের একমাত্র অবলম্বনও হারিয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের স্বল্পমাত্রার মানসিক ভোগান্তি যেমন- ভয়, উদ্বিগ্নতা, কখনো কখনো অবাক ও স্তব্ধ হওয়া ছাড়াও শোকের ভিতর দিয়েও যেতে হয় অনেককে। কারও কারও ক্ষেত্রে এসব সমস্যা কমে আসলেও আবার অনেকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানসিক দুর্দশার ভিতর দিয়েই কাটাতে হয় দীর্ঘদিন।

সমস্যার কোনো কোনোটি যেমন সরাসরি দুর্যোগের আঘাত জনিত কারণে, কোনোটি আবার দুর্যোগের ফলে জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার কারণে। অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক অবস্থা, এমনকি অনেকের জন্য সঙ্গহীনতাও এসবের বড় কারণ।

মানসিক এসব সমস্যার জন্য সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা না নিতে পারার কারণে সারা পৃথিবী জুড়েই, প্রায় অর্ধেকের মতো ভুক্তভোগীর মধ্যে ডিপ্রেশন, টেনশন জাতীয় বিভিন্ন মানসিক রোগ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

অনেক সময় শারীরিক অসুবিধার চেয়ে মানসিক অসুবিধাগুলোই একজন মানুষের ভোগান্তি ও অর্থনৈতিক সমস্যার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

দুর্যোগের ধরন প্রায় কাছাকাছি হলেও (যেমন- ভূমিকম্প, ঝড়, সাইক্লোন, যুদ্ধ, সন্ত্রাসী আক্রমন কিংবা বিভিন্ন ধরনের এক্সিডেন্ট) এসবের প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করে দেশ বা মানুষগুলোর নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, আচরণ, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা এসবের উপর। কে কিভাবে বিষয়টিকে ভাবছেন, সমস্যাটি মোকাবিলা করছেন, করতে পারছেন কিংবা শরীর বা মনই সেসব পদক্ষেপে কেমন সাড়া দিচ্ছে তার ওপর।

উন্নত অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা সবদিক থেকে ঠিক নয়। দু’টি বিষয় মনে রাখা দরকার, উন্নত দেশে এসব বিষয় সহজে সমন্বয়ের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে পারে বলে সরাসরি ভোগান্তি কম হয়। চিকিৎসা বিষয়ক সমন্বয় থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে যোগাযোগের সুব্যবস্থা বা দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার যেকোনো পদ্ধতিতেই তারা অগ্রগামী। সে তুলনায় গরীব দেশগুলি পিছিয়ে থাকে, তাই পরবর্তী সমস্যাও বেশি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে এবং অপ্রতুল অথবা কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দুর্যোগের সম্ভাবনা ও দুর্ভোগ দুটোই বেশি হয়।

যার একটি উদাহরণ হতে পারে সাভার ট্র্যাজেডি। তুলনামূলক অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেই কিন্তু বিল্ডিংটির নির্মাণ কাঠামো দুর্বল ছিলো এবং তা ভেঙে পরেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন কিংবা আনফিট গাড়ি, রাস্তা সবই এসবের মধ্যে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও এদের কম থাকে। তাই দুর্ভোগের মাত্রাও বেশি হয়।

ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরতে চাই। আফ্রিকা এবং ইউরোপে লোকসংখ্যা প্রায় সমান হলেও ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপে যেখানে প্রতিবছর গড়ে ২৩৫২ লোক মারা গেছে এবং ৫৪৮২০ লোক গৃহ হারা হয়েছে দুর্যোগের কারণে, সেখানে আফ্রিকায় প্রতিবছর গড়ে মারা গেছে ৭৫৯৫ লোক এবং ৫৫৫৮৫৮ লোক গৃহ হারা হয়েছে।
Savar-220
মানসিক সমস্যা:  
যদিও সবার ক্ষেত্রে বা সব ঘটনার ক্ষেত্রে বিষয়গুলি এক নয় বা সমান নয়, তবুও একটি সাধারণ হিসেবে দেখা গেছে যেকোনো ধরনের দুর্যোগের পর আক্রান্ত মানুষগুলোর প্রায় নব্বই ভাগই, প্রথন ঘণ্টার ভিতরেই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা বা অস্বস্তি প্রকাশ করে থাকে।

মজার বিষয় হল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, সপ্তাহের ভিতরই এসব সমস্যা ধীরে ধীরে কমে আসে। কিন্তু ১০ থেকে ১২ সপ্তাহ পর, মোট সংখ্যার বিশ ভাগ থেকে পঞ্চাশ ভাগ পর্যন্ত মানুষ, কখনো আরো বেশি সংখ্যাকের ভিতর পুনরায় এসব সমস্যা প্রকাশ পায়।

বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই সমস্যা বছর দুয়েকের মধ্যে কমে আসলেও, প্রায় এক-চতুর্থাংশের মাঝে কিছু কিছু সমস্যা থেকে যায়। অন্যদিকে এমনো দেখা যায়, গত দুই বছর কিংবা আরো বেশি সময় যারা ভালো ছিলো বা যাদের মধ্যে এধরনের কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। তাদের ভিতর নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়েছে।

তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঘটনা ঘটার তারিখটিতে বা বার্ষিকীতে। অর্থাৎ বছরের যে তারিখে ঘটনাটি ঘটেছে, সে তারিখটি ফিরে আসলেই নতুন করে আবার, কিংবা নতুন কারো ভিতর সমস্যা শুরু হতে পারে। আমাদের বিডিআর বিদ্রোহে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেসব মানুষ নিতহ হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিতরও এমন হতে দেখা গেছে।

দুর্যোগ পরবর্তী মানসিক সমস্যার ধরন নিয়ে জানব পরের সংখ্যায়...

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।