ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

মহাসংকটে সুনামগঞ্জ স্বাস্থ্য বিভাগ

শাহজাহান চৌধুরী, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১২
মহাসংকটে সুনামগঞ্জ স্বাস্থ্য বিভাগ

সুনামগঞ্জ: চিকিৎসক, সেবিকা, অবকাঠামো ও জনবল সংকটের কারণে সুনামঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগ রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছে। ফলে, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবার বিপরীতে চরম ভোগান্তিতে এ অঞ্চলের মানুষ।



সদর হাসপাতালের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায় না। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ কারণে জরুরি বিভাগের ফটক দিয়ে সবাই হাসপাতালে ঢোকেন। রোগীদের জন্য রান্না ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সর্বোপরি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া মানেই দুর্ভোগ পোহানো।

সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল: ১৯৮৪ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয় জেলার এ হাসপাতালটি। ২০০৯ সালে সুনামগঞ্জ-৪ (সদর) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মমতাজ ইকবাল (বর্তমানে প্রয়াত) হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা ঘোষণা করে এ থেকে  কাগজে কলমে ২৫০ শয্যা হলেও অবকাঠামো রয়েছে ১শ শয্যার। ৪৭ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন ১৬জন চিকিৎসক এবং ৫১ জন সেবিকার মধ্যে শূন্য রয়েছে ৩৫ জন।

চিকিৎসকের পদ শূন্য: সিনিয়র কনসালটেন্ট, চক্ষু , সার্জারি, ই.ন.টি, কার্ডিওলজি, মেডিসিন, ডেন্টাল, সিনিয়র কনসালটেন্টের(শিশু) বিপরীতে রয়েছেন জুনিয়র কনসালটেন্ট। সিনিয়র কনসালটেন্টের (এনেস্থেশিয়া) বিপরীতে রয়েছেন জুনিয়র কনসালটেন্ট, মেডিসিন,অর্থোপেডিক,ইএনটি, চর্ম ও যৌন, সার্জারি, শিশু, চক্ষু, এনেস্থেশিয়ার পদ শূন্য রয়েছে। আবাসিক সার্জন, আবাসিক ফিজিশিয়ান,অ্যানেথেস্ট ২টি পদের মধ্যে ২টিই শূন্য। সহকারী রেজিস্টার ও সহকারী সার্জনের ১২টি পদের মধ্যে ১২টি পদই শূন্য, মেডিকেল অফিসার (বিষয় ভিত্তিক)  ১২টি পদের মধ্যে শূন্য ৭টি, ডেন্টাল সার্জন ১টির মধ্যে ১টি , প্যাথলজিস্ট ১টির মধ্যে ১টি, সেব-তত্ত্বাবধায়ক ১টির মধ্যে ১টি,  প্রশাসনিক কর্মকর্তা ১টির মধ্যে ১টি,  পরিসংখ্যান কর্মকর্তা ১টির মধ্যে ১টি,উপ-সেবত্ত্বাবধায়ক ১টির মধ্যে ১টি পদ শূন্য রয়েছে অনেকদিন ধরে।

বিভিন্ন টেকনোলজিস্ট পদ শূন্য: মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) ২টি পদের মধ্যে ১টি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট(ফিজিও) ব্লাড ব্যাংক ২টি পদের মধ্যে ২টি, বায়োক্যামেস্টি/ হেমাটোলজি, রেডিওগ্রাফার ২টি পদের মধ্যে ১টি,স্টুয়ার্ড, অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি, কার্ডিওগ্রাফার, সহকারী হিসাব রক্ষক, ওয়ার্ড মাস্টার, লিয়েন কিপার, রেকর্ড কিপার, টিকেট ক্লার্ক, স্টেরিলাইজার কাম মেকানিক, জুনিয়র মেকানিক/ পাম্প অপারেটর, ক্যাশ সরকার,জমাদার/সরদার, গার্ডেনার(আয়ুবেদীক) শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে গুদাম রক্ষক ২টি পদের মধ্যে ১টি, গাড়ি চালক ২টি পদের মধ্যে ১টি শূন্য।    

শয্যা সংকট: শিশু ওয়ার্ডে ১২টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে গাদাগাদি করে এ ওয়ার্ডে ২৫ শয্যা করা হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর শনিরাব থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডে গড়ে ৯৩ জন শিশু  ভর্তি হয়েছে।

পুরুষ ওয়ার্ডে ২৪টি শয্যা, গাইনি ওয়ার্ডে ১৭টি, মহিলা ওয়ার্ডে ২৪টি, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১২টি  টিটেনাস ওয়ার্ডে ৫টি এবং কেবিনে ৬টি শয্যা থাকলেও প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩ গুণ রোগী ভর্তি রয়েছে।

রেডিওলজি বিভাগ: ৯ মাস ধরে দু’টি আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং এক্স-রে মেশিন দু’টি একটি ৩শত এমএ অপরটি ১শত এমএ। ৩শত এমএ মেশিনটি লো-ভোল্টেজের কারণে স্থাপনের পর থেকে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ১শত এমএ মেশিনটি একটি প্রাচীনকালের এক্স-রে মেশিন দিয়ে চলছে।

রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক সালেহ আহমদ আলম বাংলানিউজকে জানান, এক্স-রে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন ১শত এমএ পুরনো মেশিনটি যে কোনো সময় বিকল হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, পুরনো মেশিনে এক্স-রে করার ফলে রেডিয়েশন বিকিরণে রোগীদের শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।

তিনি আরও জানান, আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন বিকল থাকার কারণে রোগীদের বাইরে থেকে এ পরীক্ষাটি করাতে হয় এবং প্রতিদিন প্রায় ৪০টি এক্স-রে ফিল্ম ব্যবহার হয়।

প্যাথলজি বিভাগ: এ বিভাগে আধুনিকতার ছোয়া নেই। বায়োক্যামেস্টি অ্যানালাইজার মেশিন না থাকার কারণে গুরুত্বপূর্ণ প্যাথলজিক্যাল অনেক পরীক্ষা এখানে করা সম্ভব হয় না। একজন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান দিয়ে শুধু রুটিন পরীক্ষাগুলো করা হচ্ছে। ফলে, রোগীরা সরকারের প্রতিশ্রুত সেবা না পেয়ে জীবন বাঁচাতে প্রাইভেট ক্লিনিকে যাচ্ছেন। আর সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।

রোগীদের শয্যা সংকট: অবকাঠামো ও তীব্র শয্যা সংকটের কারণে মেঝেতে, বারান্দায় ও করিডোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হয় রোগীদের।

রোগীদের খবার: এক রোগীর সঙ্গে আসা হাসমত আলী জানান, রোগীদের মানসম্মত খাবার দেওয়া হয় না। রান্না ঘরের পাশে টয়লেট জ্যাম লেগে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
রোগীর সঙ্গে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থেকে আসা নাজিম উদ্দিন জানান, খাবার পানির তীব্র সংকট একটি নলকূপ অনেকদিন ধরে বিকল হয়ে আছে।

অপারেশন থিয়েটার: বিদ্যুতের শর্টসার্কিটে সংযোগটি পুড়ে যাওয়ায় ১৫ দিন কোনো অপারেশন এ হাসপাতালে হচ্ছে না। ফলে, ছোট বড় সব অপারেশনের জন্য সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ।

সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জনের বক্তব্য: সিভিল সার্জন ডা. এটিএমএ রকিব চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, রোগীদের প্রতি মাত্র ৭৫ টাকা বরাদ্দ । এতে কোনোভাবেই পর্যাপ্ত মানসম্মত খাবার পরিবেশন করা সম্ভব নয়।

৩শত এমএ এক্স-রে মেশিনটি চালানোতে প্রয়োজন নতুন বিদ্যুতের ট্রান্সমিটার। এ জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ বিদ্যুৎ বিভাগকে কয়েক দফা চিঠি দিলেও কোনো কাজ হয়নি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য যা বললেন: সুনামগঞ্জ-৪(সদর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ মতিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান,চিকিৎসক ও অবকাঠামো সংকটের বিষয়ে সংসদে ডিও লেটার দিয়েছেন। ২৫০ শয্যার জন্য নতুন ৮ম তলা ভবন তৈরির জন্য গত মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

নতুন ভবন তৈরি আশা-নিরাশার দোলাচল: সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, হাসপাতালের নতুন ভবনের দরপত্র হলেও ভবনটি নির্মাণের জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপূর্ত বিভাগ রশি টানাটানি করছে।

সূত্রে আরও জানায়,  প্রকৌশল নিয়মানুযায়ী ১শ শয্যা বিশিষ্ট ভবন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তৈরি করতে পারে। কিন্তু এর চেয়ে বড় ভবন হলে তা গণর্পূত বিভাগকে হস্তান্তর করতে হয়।

দিরাই উপজেলা: ৩১ শয্যা এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শয্যা আছে ২৫টি, ১০ জন চিকিৎসকের পদের মধ্যে ৫টি পদই শূন্য, সেবিকা ৯টি পদের মধ্যে ৭টিই শূন্য, এছাড়াও এক্স-রে মেশিন স্থাপনের পর থেকে লো-ভোল্টেজের কারণে চালানো যাচ্ছে না। জেনারেটর বিকল রয়েছে এক যুগ ধরে। এ উপজেলার ৭টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৪টিতেই কোনো চিকিৎসক নেই।

শাল্লা উপজেলা: কর্মকর্তাসহ ১০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৪টি পদ শূন্য,  সেবিকা ৯টি পদের মধ্যে ৮টি শূন্য। এ উপজেলার ৪টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৪টিতেই কোনো চিকিৎসক নেই।

জগন্নাথপুর উপজেলা: ৫১ শয্যার হাসপাতালে ৩১ শয্যার অবকাঠামো দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। ১৭টি চিকিৎসক পদের মধ্যে ২টি এডহক ভিত্তিতে এবং ৭টি পদই শূন্য এবং ২ জন সেবিকা দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য সেবা। এ উপজেলার ৭টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৫টিতেই কোনো চিকিৎসক নেই।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা: নবগঠিত এ উপজেলায় হাসপাতালের কোনো অবকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি। ৮টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৮টিতেই কোনো চিকিৎসক নেই বললেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা: সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭টি চিকিৎসক পদের মধ্যে ৭টিই শূন্য।

জামালগঞ্জ উপজেলা: ৯ জন চিকিৎসকের পদের মধ্যে ২ জনের পদ শূন্য রয়েছে। ১ জন সেবিকা দিয়ে চলছে নার্সিং সেবা। ৪টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৪টিতেই কোনা চিকিৎসক নেই।

ধর্মপাশা উপজেলা: এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯টি চিকিৎসকের পদের মধ্যে ৪টি পদই শূন্য। ২ জন সেবিকা দিয়ে চলছে নার্সিং সেবা। ৭টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৬টিতেই চিকিৎসক নেই। এ উপজেলার হাওর বেষ্টিত মধ্যনগর থানার ২০ শয্যা হাসপাতালে ৩টি চিকিৎসকের পদের মধ্যে ৩টিই শূন্য।

তাহিরপুর উপজেলা: ৯টি চিকিৎসকের পদের মধ্যে ৩টি শূন্য। ১ জন সেবিকা দিয়ে চলছে হাসপাতালের নার্সিং কার্যক্রম। এ উপজেলার ৪টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কোনোটিতেই চিকিৎসক নেই।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা: স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ৯টি পদের মধ্যে ৫টি শূন্য। ২ জন সেবিকা দিয়ে চলছে নাসিং সেবা। ৫টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৫টিতেই কোনো চিকিৎসক নেই।

দোয়ারাবাজার উপজেলা: ৯টি চিকিৎসকের মধ্যে ৩টি পদ শূন্য। ২ জন সেবিকা দিয়ে চলছে সেবা কার্যক্রম। ৭টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৬টিতে কোনো চিকিৎসক নেই।

ছাতক উপজেলা: চিকিৎসকের ৯টি পদের মধ্যে ৩টি পদই শূন্য। ৩ জন সেবিকা দিয়ে চলছে সেবা দান। এ উপজেলার ১২টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৯টিতেই কোনো চিকিৎসক নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১২
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad
welcome-ad