ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ মে ২০২৪, ০০ জিলকদ ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

ফরিদপুরে থামছে না ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০২৩
ফরিদপুরে থামছে না ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল

ফরিদপুর: ফরিদপুরে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন রোগী।

তবে মৃত্যু ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান তেমন কোনো উদ্যোগও নেই। নেই মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুরে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

চিকিৎসকদের দাবি, অসচেতনতার কারণেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর রোগী যখন অনেকটা সুস্থবোধ করছেন তখনই মারা যাচ্ছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ৫ম, ৬ষ্ঠ ও সপ্তম দিন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় রোগীরা অনেকটা সুস্থবোধ করায় চিকিৎসা ও সচেতনতা থেকে অনেকটা দূরে থাকেন। আর তাই এ সময়ে মৃত্যু হচ্ছে রোগীদের।

বুধবার (১৮ অক্টোবর) ফরিদপুর সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে এ মৃত্যুর বিষয়টি জানা যায়।  

মারা যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকার আব্দুল মজিদ মিয়া (৭০), জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার উত্তর চরনারানদিয়া এলাকার সারমিন আক্তার (১৩), জেলা সদরের শিবরামপুর এলাকার সবদার আলী (৭০), জেলার মধুখালী উপজেলার পরীক্ষিতপুর এলাকার মরিয়ম বেগম (৪৮) ও ঝিনাইদহের হরিপুরের রুপদাহ এলাকার অঞ্জলি (৪০)।

এদের মধ্যে সারমিন, সবদার আলী, মরিয়ম ও অঞ্জলি ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া আব্দুল মজিদ মিয়া নিজ বাড়ি সদরপুরের রামচন্দ্রপুর গ্রামে মারা যান।  

ফরিদপুরের কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ হাসপাতালে বেডের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি। চিকিৎসকরাও রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সিট না পেয়ে ফ্লোরে ও সিঁড়ির আশপাশে বেড পেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। অনেকে সিট না পেয়ে আশপাশের প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে ছুটছেন একটি বেডের আশায়। আবার স্যালাইন সংকটে চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার দাবি তুললেন কয়েকজন রোগীর স্বজনরা।

এসময় কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত জিয়াসমিন বেগম (৩০) নামে এক গৃহবধূর সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ফরিদপুরের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড না থাকায় কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ঘুরে বেড না পেয়ে অবশেষে শহরের ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালে একটি বেড পেয়ে ভর্তি হই। বেশিরভাগ হাসপাতালেই বেড পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান এই  রোগী।

ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া নাসরিন আক্তার, মরিয়ম ও শারমিনসহ কয়েকজন রোগী অভিযোগ করেন, হাসপাতালটিতে চিকিৎসক রোগীর কাছে ঠিকমতো আসেন না। রোগীদের সঙ্গে আচার-ব্যবহারও ভালো করেন না। হাসপাতালের কর্মরত সেবিকাদের আচরণও সন্তোষজনক নয় বলে জানান তারা। অনেক সময় চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলায় রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন রোগীর স্বজন।  

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন হাসপাতালটির কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সরা। তাদের দাবি, ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি ও অন্যান্য সাধারণ বেডের রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। অনেক সময় রোগীরা ডেঙ্গুর সর্বশেষ পর্যায়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি হন। সে কারণে  অনেকে মারা যাচ্ছেন।

ফরিদপুরের একাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুরে শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। তবে শহরে মাঝে মধ্যে একটু আধটু ফগার মেশিন দিয়ে মশা নিধনে অভিযান চালালেও সচেতনতামূলক তেমন প্রচার প্রচারণা নেই বললেই চলে।  

এ ছাড়া গ্রাম-গঞ্জে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও সেখানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম কিংবা মশা নিধনে কোনো উদ্যোগ নেই। অনেকের দাবি, করোনার সময় স্বয়ং সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছিল, ডেঙ্গুর এ ভয়াবহ অবস্থায় কারো তেমন কোনো সক্রিয় উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সবার নিস্ক্রিয়তায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

এ ব্যাপারে কথা হয় ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালার সঙ্গে।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শহরের তুলনায় গ্রাম-গঞ্জে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ বেশি মারা যাচ্ছেন। তবে, সেখানে ডেঙ্গু সচেতনতার পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই। তাইতো গ্রাম-গঞ্জে মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।

পান্না বালা আরও বলেন, করোনার সময় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ছাড়াও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু, ডেঙ্গুর এ ভয়াবহতায় সবাইকে কেন যেন উদাসীন মনে হচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে করোনা সময়ের মতো সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

এ ব্যাপারে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. এনামুল হক বাংলানিউজকে জানান, ফরিদপুরের হাসপাতালগুলোতে বেডের তুলনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। এ জন্য অনেক সময় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ রোগী মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে বাকিদের ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রেফার্ড করা হচ্ছে। এছাড়া রোগীদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বাড়ার ব্যাপারে হাসপাতালটির পরিচালক জানান, রোগীদের একদম ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। এছাড়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার পর পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম দিনে কিছুটা সুস্থ মনে হলেও আসলে সেসময়ই রোগীদের ক্রিটিক্যাল সময়। আর এসময়ই সচেতনতার অভাবে রোগী বেশি মারা যাচ্ছে। তাই এসময়টাতে আরও অধিক যত্নশীল ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া ওষুদের পাশাপাশি বেশি করে তরলজাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে রোগীকে।

এ ব্যাপারে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে নানা সচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ডেঙ্গু রোগে যেন আক্রান্ত না হয় সেজন্যও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল আহসান তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, শহরের পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জে ডেঙ্গু সচেতনতা বাড়াতে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ সচেতনতা কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।  

এছাড়া জেলায় স্যালাইনের সংকট রয়েছে স্বীকার করে জেলা প্রশাসক বলেন, জেলায় কিছুটা স্যালাইন সংকট রয়েছে। সে কারণে রোগীদের চিকিৎসা দিতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইনের বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত স্যালাইন সংকট কেটে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।