চট্টগ্রাম: দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে শহীদ হামজা ব্রিগেডের জন্য আসা টাকা বিভিন্ন কৌশলে এই সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনটির কাছে পৌঁছানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হওয়া তিন আইনজীবী ও ব্যবসায়ী এনামুলসহ বেশ কয়েকজনকে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে তথ্য পেয়েছে র্যাব।
র্যাবের দাবি, গ্রেপ্তার হওয়া চারজন ‘জেনেবুঝে’ হামজা ব্রিগেডের নেতার অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো দিয়েছিল। তারা ‘জেনেবুঝেই’ ব্যবহার হয়েছিল।
র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের পরিচালক লে.কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তারা মূল অর্থদাতা নন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সোর্স থেকে টাকাগুলো এসেছিল। সেই টাকা জঙ্গি সংগঠনের নেতার অ্যাকাউন্টে তিন আইনজীবী ও ব্যবসায়ী এনামুল যে জমা দিয়েছিলেন সেই তথ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে আছে। তারা যদিও ভিন্ন কথা বলছেন, যেহেতু অর্থ জমা দেয়ার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে, এখন তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা জঙ্গি অর্থায়ন করেননি। কিন্তু নথিপত্র বলছে, তারা টাকা দিয়েছিল।
র্যাব জানায়, শহীদ হামজা ব্রিগেডের একটি উইংয়ের প্রধান মনিরুজ্জামান মাসুদ ওরফে ডনের ১৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছে তারা। এর মধ্যে কয়েকটি অ্যাকাউন্ট তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সানজিদা এন্টারপ্রাইজের নামে খোলা হয়েছে। কয়েকটি অ্যাকাউন্টে ২০১৪ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে কয়েক দফায় এক কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা জমা হয়েছিল।
‘ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকা জঙ্গি অর্থায়নে ব্যবহৃত হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এখন তারা (গ্রেপ্তার চারজন) জেনেবুঝে সেই টাকা অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছেন নাকি না জেনেই দিয়েছেন সেটা তারাই প্রমাণ করুক। ’ বলেন মিফতাহ।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া চারজন পাঁচ ধাপে ডনের মালিকানাধীন সানজিদা এন্টারপ্রাইজের অ্যাকাউন্টে এক কোটি ২৪ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছিল। এর মধ্যে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা দুই ধাপে ৫২ লক্ষ টাকা, অ্যাডভোকেট মো.হাসানুজ্জামান লিটন ৩১ লক্ষ টাকা, অ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপন ২৫ লক্ষ টাকা এবং মো.এনামুল হক ১৬ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। ডনের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া বাকি ১৪ লক্ষ টাকা কারা দিয়েছিল সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে পুলিশের এ বিশেষ ইউনিটের কর্মকর্তারা।
টঙ্গীর তুরাগ তালতলার নয়নীচালায় গোল্ডেন টাচ অ্যাপারেলস এর মালিক এনামুলকে শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাতে টঙ্গির তুরাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৮ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাসহ তিন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব।
র্যাব জানিয়েছে, ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের রাজধানীর উত্তরা শাখায় গিয়ে ডনের সানজিদা এন্টারপ্রাইজের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছিলেন এনামুল। একই ব্যাংকের চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোড শাখার আরেকটি অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো পাঠানো হয়েছিল।
সূত্রমতে, জিজ্ঞাসাবাদে এনামুল জানিয়েছেন, তার পোশাক কারখানায় প্যান্ট তৈরির অর্ডার দিয়েছিলেন তিন ব্যক্তি। সেই অর্ডারের অগ্রিম বাবদ তাকে ১৬ লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের আগস্টে ওই তিনজন এনামুলের সঙ্গে রাজধানীর উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে দু’টি রেস্টুরেন্টে দুই দফা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে টাকাগুলো লেনদেন হয়েছিল। কিন্তু অর্ডারমত প্যান্ট সরবরাহ করতে না পারায় পরবর্তীতে তিনি টাকাগুলো ফেরত দেন।
‘এনামুল বলেছেন পোশাক তৈরির জন্য অগ্রিম টাকা পেয়েছিল। কিন্তু কারা পোশাকের অর্ডার দিয়েছিল, তাদের নাম-পরিচয় কি, কেন তারা নগদে এতগুলো টাকা দিল-এসব প্রশ্নের কোন উত্তর তার কাছে নেই। এনামুল যে টাকা পেয়েছিল সেই প্রমাণও তার কাছে নেই। ’ বলেন র্যাব-৭ এর পরিচালক মিফতাহ।
মিফতাহ বলেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াও নগদে এবং হুন্ডির মাধ্যমে হামজা ব্রিগেডের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা এসেছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, তবে এখনও প্রমাণ পায়নি। দুবাইয়ের নাগরিক আল্লামা লিবদিও দেশে এসে টাকা দিয়েছেন।
‘শহীদ হামজা ব্রিগেডের উইং প্রধান ছাড়া আর কেউ আল্লামা লিবদিকে চিনেনা। আমাদের কাছে যতটুকু তথ্য আছে, তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসে হামজা ব্রিগেডের উইং কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং টাকা দিয়েছেন। লিবদি বাংলায় কথা বলতে জানেন না। ’ বলেন মিফতাহ।
এনামুল যে প্রক্রিয়ায় টাকা দেয়ার কথা র্যাবকে জানিয়েছে একই প্রক্রিয়ায় ডনের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেবার কথা জানিয়েছিলেন ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাও।
২৬ আগস্ট চট্টগ্রামের একটি আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে শাকিলা ফারজানা জানিয়েছিলেন, হেফাজতের মামলা পরিচালনার জন্য ওসমান আমিন ও মাসুম নামে দু’জন মিলে তাকে এক কোটি ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি হেফাজতের নেতাকর্মীদের জামিন করাতে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে তিনি ওই টাকা থেকে ১২ লক্ষ টাকা তার ফি বাবদ রেখে বাকি টাকা সানজিদা এন্টারপ্রাইজের অ্যাকাউন্টে ফেরত দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র্যাবের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, শাকিলা ফারজানা জঙ্গি সংগঠনের টাকা জেনেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন বলে আমরা ধারণা করছি। ওই টাকা অ্যাকাউন্টে দেয়ার জন্য ১২ লক্ষ টাকা নিজের লাভ রেখে বাকি টাকা সম্ভবত তিনি জমা দিয়েছিলেন। একইভাবে এনামুলও সম্ভবত টাকার বিনিময়ে এই কাজ করেছেন। এখন টাকার উৎস কোথায় সেটা আমাদের অনুসন্ধান করে দেখতে হবে।
শাকিলাকে যে ওসমান আমিন টাকা দিয়েছিল, এনামুলকেও একই ব্যক্তি দিয়েছিল কিনা জানতে চাইলে র্যাব পরিচালক বলেন, টাকা যিনি এনামুলকে দিয়েছেন তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সে দিতে পারছেনা। আর তিন আইনজীবীকেও এনামুল চিনেনা।
র্যাব সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালের ১৮ জুন যশোরে জন্ম নেয়া এনামুলের বাবার নাম মতিউর রহমান। যশোরের সাগরগাতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি ও অভয়নগর উপজেলায় নোয়াপাড়া মহাবিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এইচএসসি পাশ করেন এনামুল। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত খুলনা বিএল কলেজে অর্থর্নীতিতে অনার্স পড়েন এনামুল। এসময় তিনি গ্র্যান্টস নামে একটি দেশিয় প্রতিষ্ঠানে মাশরুম সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন।
২০০৪ সালে ঢাকার তিতুমির কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন এনামুল। এরপর তিনি মহাখালীতে একটি ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন মার্চেন্ডাইজিং কোর্স করেন।
তিন ভাইয়ের মধ্যে এনামুল মেঝ। বড় ভাই সৌদি আরব থাকেন এবং ছোট ভাই গ্রামের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
এনামুল ২০০৬ সালের ৬ মে পলমল গ্রুপে যোগ দেয়। বছরখানেক চাকুরি করার পর সেটা ছেড়ে দিয়ে যোগ দেয় ঢাকা ইপিজেডে এম জে ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোরিয়ান পোশাক কারখানায়। এক বছর সেখানে চাকুরি করার পর তিনি মাগুরা জেলায় গাবখালী ইউনাইটেড কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক পদে যোগ দেন।
এক বছর কলেজে শিক্ষকতা করার পর ঢাকায় এসে বড় ভাইয়ের টাকায় গার্মেন্টসে সাপ্লাইয়ের কাজ শুরু করেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দু’জন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন গোল্ডেন টাচ অ্যাপারেলস। সেখানে ৫৬ জন কর্মচারি আছেন।
র্যাব-৭ এর পরিচালক লে.কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এনামুল টাকা দিয়েছিল মাশরুমের ব্যবসার তথ্য উল্লেখ করে। কিন্তু এখন বলছেন, পোশাকের অর্ডার নির্ধারিত সময়ে দিতে না পারায় টাকা ফেরত দিয়েছেন। তার যদি সৎ উদ্দেশ্য থাকত তাহলে ব্যাংকের নথিপত্রে মিথ্যা তথ্য দিলেন কেন ?
শনিবার রাতে আটকের পর বাঁশখালী থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে এনামুলকে রোববার দুপুরে আদালতে পাঠিয়েছিল র্যাব। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছিল। শুনানি শেষে বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তার পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৫
আরডিজি/টিসি