ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

উত্তরা গণভবন-২

কোথায় এলাম আমি!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৭ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৫
কোথায় এলাম আমি! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উত্তরা গণভবন থেকে ফিরে: বাইরে দেখে যে কারো মনে হতে পারে, কোথায় এলাম আমি! এতো অনাদর সহ্য করা যায় না! তবে ভেতরে খানিকটা গোছানো।

চারটি ভবনের মধ্যে একটির থেকে অন্যটির দূরত্ব প্রায় একশ’ গজের বেশি।

চারদিকে পরিখা, বিশাল খোলা মাঠ আর দুর্লভ প্রজাতির ফলজ, বনজ, ঔষধি ও সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ।

প্রধান ফটক পার হতেই হাতের দুই দিকে চোখে পড়বে বিশাল লেক। দেখতে লেক মনে হলেও মূলত রাজবাড়ির চারপাশ ঘিরে তৈরি করা পরিখা।   যাতে বর্হি শত্রু সহজেই আক্রমন করতে না পারে। রাজার আমলে লেকের ওপর ছিল কাঠের পুল। পুল তুলে স্থায়ী লিংক রোডও নির্মাণ করা হয়েছে।
 
পরিখায় অসংখ্য পদ্মফুল ফুটেছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। ঠিক যেন গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই ফুল দিয়ে বরণ করা হচ্ছে।

লিংক রোড পেরিয়ে গেলেই হাতের বামে পড়বে রাজ দরবারের চাবি ঘর। যা এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের স্থানীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কিছুদূর এগিয়ে গেলেই হাতের বামে পড়বে রাজকুমার প্যালেস। বিশেষ ধরনের দ্বিতল ভবনটি নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে।

কেউ কেউ বলেন, যারা খাজনা দিতে চাইতেন না। সে সব প্রজাদের ধরে এনে এই ভবনের নিচতলায় অন্ধকার কক্ষে আটকে শাস্তি দেওয়া হতো।

ভবনটির নিচতলায় একটি মাত্র দরজা আছে। রয়েছে ছোট ছোট কিছু জানালাও।   নিচতলার ছাদটি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক নিচু। রাজকুমার প্যালেসটির ওপর ও নিচতলা তালা দিয়ে রাখা হয়েছে।

ভবনটির সামনে শোভা পাচ্ছে একটি কামান। অনেক দর্শনার্থীকে কামানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নানা কসরতে ছবি তুলতেও দেখা গেছে। ছবি তোলার ভাব এমন ঠিক যেন কামান থেকে গুলি ছুঁড়ছেন তিনি!

এই ভবন থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে রাজপ্রসাদ। যা এখন প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূল ভবন ও পরিখার মাঝে বিশাল মাঠ। আর মাঠের চারদিকে রয়েছে হৈমন্তী তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতাসহ দুর্লভ প্রজাতির গাছ-গাছালি।

হৈমন্তী গাছটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। দেখতে কামিনী ফুলের মতো সাদা তবে কৃষ্ণচূড়ার ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো গাছ। কোন পাতা দেখা যাচ্ছে না! দূর থেকে দেখলে বড় ফুলের তোড়া মনে হতে পারে।

নির্মাণকাল গণনা করলে ভবনটির বয়স দাঁড়ায় ২৫৮ বছর। কিন্তু এর নির্মাণ শৈলী জানান দিচ্ছে শুধু আধুনিক নয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ভবনটি।

এতদিন পর ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে ভবনে সূর্যের আলো প্রবেশের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে দিনে লাইট না জ্বালালেও চলে।
 
এতে একদিকে আর্থিক সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উপাদনের সময় দূষণ থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ।

কিন্তু ২৫৮ বছর আগে নির্মিত এই ভবনটির শুধু শয়ন কক্ষ ছাড়া কোন কক্ষে দিনে লাইট জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ে না।

জানালা দিয়ে আলো আসারও প্রয়োজন নেই। ছাদ এমনভাবে তৈরি কক্ষগুলোতে হাজার পাওয়ারের এলইডি লাইট জ্বালিয়ে রাখার মতো উজ্জ্বল।
 
করিডোর, ইনডোর গেমস কক্ষ ও ওয়াশ রুম একই আদলে তৈরি। যেখানে দিনের বেলা লাইট জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ে না।

ভবনটির বাম দিয়ে একটি করিডোর ডিঙ্গিয়ে গেলে পড়বে ছোট্ট একটি কক্ষ। কক্ষটির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ওয়াশ রুম।

ওই করিডোর ধরে এগিয়ে গেলে পড়বে প্রধান শয়ন কক্ষ। যা রাজাদের শয়ন কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হত।

এখন প্রধানমন্ত্রীর শয়ন কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর শয়ন কক্ষটিতে রয়েছে রাজাদের ব্যবহৃত একটি খাট, ড্রেসিং টেবিল, একটি ইজি চেয়ার ও ছোট্ট একটি টেবিল। শয়ন কক্ষটির সঙ্গে রয়েছে বিশাল একটি ওয়াশ রুম।

এই কক্ষটি থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে ফেরত এলে ডানে রয়েছে ইনডোর গেমস রুম।

এর সামনে জলসা ঘর। ঠিক মাঝখানে রয়েছে বিশাল বড় কনফারেন্স রুম। কনফারেন্স রুমের পশ্চিমে বিশাল ডাইনিং স্পেস, দক্ষিণে রয়েছে দু’টি শয়ন কক্ষ।

ভবনের পশ্চিমে কয়েক ফুট ব্যবধানে শান বাঁধানো ঘাট পরিখার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে।

প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে ঐতিহাসিক সব নিদর্শন। রয়েছে রাজার ব্যবহৃত বর্ম। অনেকগুলো মুর্তি। রয়েছে পুরানো ‌আমলের বাহারি ডিজাইনের সব ফার্নিচার।

যা এখনও চকচক করছে। রয়েছে আড়াইশ বছর আগের একটি বাগান ফ্যান। নিঃশব্দে এখনও ‍বাতাস দিয়ে যাচ্ছে।

দেখতে গোল টি টেবিলের মতো। টেবিলের নিচে উল্টো করে লাগানো হয়েছে ফ্যানের পাখা। পাশে চেয়ারে বসলে পা ও শরীরে বাতাস লাগবে, কিন্তু টেবিলের ওপর রাখা যাবে যে কিছু।

সেখানে বাতাস লাগবে না। জনশ্রুতি আছে রাতে বাগানে বসলে গরম থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং শরীরে যাতে মশা বসতে না পারে, সেজন্য ফ্যানটি চালিয়ে রাখা হতো।

প্রধান শয়নকক্ষের দক্ষিণে রয়েছে বিশাল বাগান। যা রাণীর বাগান বলে পরিচিত। বাগানে রয়েছে মার্বেল পাথরের কয়েকটি নারী মুর্তি।

পুরো বাগানটি নানান জাতের দেশি-বিদেশি বৃক্ষে ভরা। মাঝ বরাবর রয়েছে পানির ফোয়ারা। অন্যান্য ভবন থেকে প্রাচীর দিয়ে আলাদা করা হয়েছে বাগানটিকে। শুধু মূল ভবন থেকে সেখানে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

আর বাগানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত রাজকুমার প্যালেসের যাওয়ার জন্য ছোট্ট একটি দরজা রয়েছে।

উত্তরা গণভবনের মোট জমি রয়েছে ৪৩.৩ একর। প্রাচীরের মধ্যে রয়েছে ৩৯.৫ একর। ৩.৮ একর জমি রয়েছে প্রাচীরের বাইরে।

১৭৫৭ সালে প্রসন্ন নাথ রায় বাহাদুর রাজদরবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। যা দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভবনটি।

নির্মাণ শৈলী অক্ষুণ্ন রেখে ১০ বছর ধরে পুন:নির্মাণ করা হয় ভবনটি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায় দেশ ত্যাগ করে চলে যান। এরপর পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার গর্ভনর হাউস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
 
স্বাধীনতা পরবর্তী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান একে উত্তরা গণভবন (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) ঘোষণা করেন।

এখানে তিনি নিজে একাধিকবার থাকার পাশাপাশি ক্যাবিনেটের মিটিংও করেছিলেন। ঢাকায় অবস্থিত ‘গণভবন’ ও ‘উত্তরা গণভবন’ একই মর্যাদা সম্পন্ন।

উত্তরা গণভবন চত্বরে কাছারিপুকুর, কালীপুকুর, গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কেষ্টজির পুকুর নামে ছয়টি পুকুর রয়েছে। প্রতিটি পুকুরে রয়েছে সানবাঁধানো একাধিক ঘাট।

দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গেছে। কচুরিপানায় ভরপুর হয়ে উঠেছে পানি গিয়ে ঠেকেছে তলানীতে।

২০১২ সালের অক্টোবর মাসে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রবেশের জন্য নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকার টিকিট। টিকিট কেটে মূল ভবন ও রাণীর বাগান ছাড়া সর্বত্র যাওয়া যায়।

জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে মূলভবন ও রাণীর বাগান পরিদর্শন করা যায়। দৈনিক দুই থেকে সাত’শ দর্শনার্থীর আগমন ঘটে বলে জানান টিকিট মাস্টার ফাতিমা বেগম।
 
নাটোর শহর থেকে যাওয়ার জন্য ইজিবাইক অথবা রিকশায় যাওয়া যায়। ইজিবাইকে জনপ্রতি ১০ টাকা আর রিজার্ভ নিলে ৫০ টাকা দিতে হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩১ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৫
এসআই/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ