ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘অভিজাত’ টেবিলে অতিথি পথশিশু

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫
‘অভিজাত’ টেবিলে অতিথি পথশিশু ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: অবহেলায় বেড়ে ওঠা শরীরে ময়লার আস্তরণ। আপাতদৃষ্টিতে চেহারায় খানিকটা কোমলতার ছাপ থাকলেও ঠোঁটে, মুখে পড়ে গেছে ঘন কালো দাগ।

মাথার চুল থেকে যেন চুইয়ে পড়ছে তেল। এ বিবরণ একদল পথশিশুর, যাদের ঠাঁই রেলস্টেশনে-বস্তিতে, সমাজের যেখানে ‘ভদ্রমানুষের’ পা পড়েনা।

এমন চার পথশিশু যখন শনিবার দুপুরে নগরীর জিইসি মোড়ে অভিজাত রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে চিকেন বিরিয়ানির ঘ্রাণ নিচ্ছিল, তখন উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল সেখানে আসা অভিজাত পল্লীর বাসিন্দারা। সাধারণত রেস্টুরেন্টের সামনে এ ধরনের পথশিশুদের দেখলে নিরাপত্তারক্ষীর ‘দুর দুর’ করে তাড়িয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু চার পথশিশুকে নিজের অতিথি করে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার। ফলে অভিজাত রেস্টুরেন্টের দরজা পথশিশুদের জন্য খুলে গিয়েছিল সহজেই।

চার পথশিশু হল, নাজমুল (১১), শুক্কুর মিয়া (১৩), আব্দুল আজিজ (১১) এবং সাব্বির (১২)।

বছরখানেক আগেও এরা নগরীর রেলস্টেশনে চুরি, ছিনতাই করত, পকেট কাটত। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ কমিশনার বাবুল আক্তার তাদের ধরে এনে ভর্তি করে দেন স্কুলে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের তত্তাবধানে তারা পড়ছে স্কুলে।

২০১৪ সালের জুলাইয়ে বাবুল আক্তার চলে যান দক্ষিণ সুদানের জাতিসংঘ মিশনে। সম্প্রতি ছুটি কাটাতে ফিরেছেন দেশে। চট্টগ্রামে আসার খবর পেয়েই বাবুল আক্তারের কাছে ছুটে আসেন সেই পথশিশুরা।

অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আগেও একবার ছুটিতে দেশে এসেছিলাম। কিন্তু শিশুদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। তখন এরা মন খারাপ করেছিল। এবার আমি এসেছি শুনেই ছুটে এসেছে। আমিও ভাবলাম, তাদের সঙ্গে একবেলা ভাত খাই। এ ধরনের রেস্টুরেন্টে তো সাধারণত এদের প্রবেশাধিকার নেই। আমি তাদের নিয়ে বসলাম।

দুপুর ২টার দিকে জিইসি মোড়ের বাসমতি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, পথশিশুদের সঙ্গে হাসিমুখে খোশগল্পে মেতে আছেন বাবুল আক্তার। পড়ালেখার খোঁজখবর নিচ্ছেন। বার্ষিক পরীক্ষায় কে‍ান বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছে, জানতে চাচ্ছেন সেই তথ্যও।

সাব্বির বলল, স্যার অংকে ভাল নম্বর পাইছি। ৬০ পাইছি। বাংলায় আরও ভাল পাইছি, ৭৩। ইংলিশে ৫২ পাইছি। আজিজ বলে, স্যার অংকে একটু কম পাইছি, ৩৯। আগামীবার ভাল করব।

নাজমুলের জবাব, স্যার অংকে ফেল করছি, মাত্র ৩০ পাইছি। প্রশ্ন যে কঠিন হইছে ! শুক্কুর বলে, এবার পিএসসি দিব। দোয়া করবেন স্যার।

আর কোনদিন চুরি করবা, এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন বাবুল আক্তার। জবাবে আজিজ বলে, স্যার আগে চুরি করতাম। এখন ভাল লাগেনা। এখন শুধু পড়তে মন চায়। এক সেট স্কুলের ড্রেস কিনে দেন স্যার।

বাবুল আক্তার তাকান অপরাজেয় বাংলাদেশের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মাহবুব-উল-আলমের দিকে। মাহবুব বলেন, স্যার, একসেট করে সবাইকে কিনে দিয়েছি। প্রয়োজনে আবারও দেব।

পথশিশুরা কখনও হাসিঠাট্টায় মেতে উঠছে এই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে, আবার কখনও আগেরবার এসে দেখা না করায় অভিমানের সুরে কথা বলছে। কেউ তার কাছে বিদেশের ফোন নম্বর খুঁজছে কথা বলার জন্য, আবার কেউ মুঠোফোনে সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

পথশিশুদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বাবুল আক্তার নিয়ে যান তার দুই বছরের শিশুকন্যাকেও। অবুঝ শিশুটিকেও মাঝে মাঝে আদর দিচ্ছেন পথশিশুদের কেউ কেউ।

অপরাজেয় বাংলাদেশের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মাহবুব-উল-আলম বাংলানিউজকে বলেন, বাবুল স্যারের কথা ছেলেগুলো সবসময় বলে। প্রায়ই বলে, একটু স্যারকে ফোন দেন, কথা বলব। স্যার কখন আসবে, এসব কথা বলতে বলতে অস্থির করে ফেলে।

মাহবুব জানান, সাব্বির, নাজমুল ও আব্দুল আজিজ পড়ে এনায়েতবাজারে এবাদুল্লাহ পন্ডিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। আর শুক্কুর পড়ে রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে।

এদের মধ্যে শুধুমাত্র নাজমুল থাকে অপরাজেয় বাংলাদেশের শেল্টার হোমে। বাকিরা থাকেন মা-বাবার কাছে। তবে ‍চারজনের লেখাপড়ার সার্বিক খরচ বহন করছে এ উন্নয়ন সংস্থাটি।

শুক্কুর বাংলানিউজকে জানায়, রেলস্টেশনে পেশাদার অপরাধী গডফাদার ইদু আছে। ইদু’র বাহিনীতে কাজ করত তারা। ট্রেন যাত্রীর পকেট কেটে মানিব্যাগ ও মোবাইল নিয়ে নেয়া, ভ্যানিটি ব্যাগ টান মেরে পালিয়ে যাওয়া, যাত্রীর ‍অসতর্কতায় তার মালামাল চুরি করে নেয়াসহ বিভিন্ন অপরাধ তারা সংঘটিত করত ইদু’র প্রশিক্ষণ মোতাবেক।

অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ১১ জন অপরাধীকে আমরা রেলস্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। এদের মধ্যে পাঁচজনের পড়ালেখার বয়স থাকায় তাদের ‍অপরাজেয় বাংলাদেশে হস্তান্তর করি এবং স্কুলে ভর্তি করে দিই। বাকিদের বিভিন্ন ট্রেড কোর্সে ভর্তি করি। স্কুলে ভর্তি হওয়া পাঁচজনের মধ্যে সুজন নামে একজন পরে অপরাজেয় বাংলাদেশের শেল্টার হোম থেকে চলে গেছে।

আজিজ জানায়, ইদু’র গ্রুপ ছেড়ে দিলেও এখন তার স্ত্রী দেখা হলে তাদের হুমকিধমকি দেয়। তাদের দলে ফেরত যাবার কথা বলে।

আজিজ বলে, স্যার আমরা আর কোনদিন খারাপ পথে যাবনা। আমরা এখন কাউরে ডরাইনা স্যার।

সাব্বির বলে, আগে তো বাবুল আক্তার স্যার ইদুরে দৌঁড়াইত। এখন আমরা দৌঁড়ামু।

চার পথশিশু অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে। তাদের চোখে এখন অনেক স্বপ্ন। শুক্কুরের স্বপ্ন সে সরকারি অফিসার হবে। সাব্বির জানায় সে ‘বাবুল আক্তার স্যারের’ মত পুলিশ হতে চায়। আজিজেরও স্বপ্ন ‘ডিবি পুলিশ’ হওয়া। আর নাজমুল স্বপ্ন দেখে আইনজীবী হওয়ার।

অপরাজেয় বাংলাদেশের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মাহবুব-উল-আলম বাংলানিউজকে বলেন, বাবুল আক্তার স্যার যে শুভ উদ্যোগ নিয়েছেন এমন উদ্যোগ নেয়ার মত মানুষ যদি আরও থাকত, আমাদের সমাজটা অনেক সুন্দর হত। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য যে কোন শুভ উদ্যোগে অপরাজেয় বাংলাদেশ সবসময় পাশে থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

চট্টগ্রাম প্রতিদিন এর সর্বশেষ