ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অবরোধ-হরতালেও কমেনি দইয়ের দাম!

বেলাল হোসেন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৫
অবরোধ-হরতালেও কমেনি দইয়ের দাম! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শেরপুর (বগুড়া): ‘দই মিষ্টি ক্ষিরসা, রাজা বাদশা শেরশাহ’ ‘মসজিদ মন্দির মূর্চাঘুর এসব মিলেই শেরপুর’।

প্রায় দুইশ বছর ধরে বগুড়ার শেরপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে দই।



শেরপুরের পৌরসভার ঘোষপাড়ায় হাতে গোনা দুই একজন ঘোষ নিজের প্রয়োজনে বাড়িতে সামান্য পরিমান দই তৈরি করতেন। সময়ের ব্যবধানে সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে। অনেক পরিবারই দই তৈরির সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করেছেন।

পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে ধীরে ধীরে তারা শুরু করেন দই ব্যবসা। এক সময় জীবীকার তাগিদেই বাণিজ্যিকভাবে দই বানানো শুরু করেন তারা। এভাবে দই বানানোর পরিধি ব্যাপক বেড়ে যায়।

এ অঞ্চলের সব শ্রেণি পেশার মানুষ বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা, হালখাতা ও হাত ভেজানোসহ যেকোন ধরনের অনুষ্ঠান দই ছাড়া কল্পনাও করতে পারেন না। অতিথিদের ঝাল খাওয়ানো শেষে স্বাদে ভরপুর সেই দই খাওয়াতে না পারলে এখানকার লোকজন মনে করেন আপ্যায়নে একটা কমতি রয়েই গেলো।

এদিকে দুইশ বছরের সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ২০দলীয় জোটের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ও হরতালের কারণে বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির কারণে ইতিহাসখ্যাত এসব দই ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম।

পরিবেশ পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে অনেক দই ব্যবসায়ী দই তৈরি বন্ধ রেখে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন। আর হাতে গোনা কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী লোকসান ঠেকাতে সীমিত আকারে দই তৈরি করছেন।

তারা স্থানীয় বাজারের চাহিদা বুঝে দই তৈরি করছেন। এতে বাজারে সব সময় দইয়ের সংকট থেকেই যাচ্ছে। এ কারণে দুধের দাম কমলেও দইয়ের দাম আগের মতই রয়ে গেছে।

অবরোধ-হরতালের কারণে ব্যবসায়ীরা দই তৈরির পরিমান কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন। এতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তারা।

কোনো রকমে পারিবারিক এ ব্যবসা ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে তারা দাবি করেন।

মঙ্গলবার (১০ মার্চ) শহরের একাধিক দই ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে এসব তথ্য উঠে আসে।

‘শেরপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক ইতিহাসবিদ প্রাক্তন অধ্যক্ষ রোস্তম আলী বাংলানিউজকে জানান, প্রায় দুইশ বছর আগে দই তৈরির প্রধান উপাদান দুধের চাহিদা মেটাতে সে সময় ঘোষ পরিবারগুলো নিজেরাই গাভী পালন করতেন।

এ ব্যবসাকে ঘিরে তখন ঘোষপাড়া এলাকায় ছোট পরিসরে দুধের বাজার বসতো। এরই ধারাবাহিকতায় পৌরসভার সকাল বাজার ও রেজিস্ট্রি অফিস এলাকায় দুটি বড় দুধের বাজার গড়ে ওঠে।

এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ উপজেলায় প্রায় ৮০ থেকে একশটির মত ছোট-বড় দই তৈরির কারখানাও গড়ে ওঠে। বর্তমানে শহর এলাকায় প্রায় ২০-৩০টির মত বড় দই কারখানা রয়েছে।

এর মধ্যে গোপাল ঘোষ, ভূষণ ঘোষ, নিতাই ঘোষ, নিমাই ঘোষ, ফনি ঘোষ, সন্তোষ ঘোষ, নন্দ ঘোষ, আনন্দ ঘোষ, উত্তম ঘোষ, গুপিনাথ ঘোষ, গোবিন্দ ঘোষ, প্রদ্যূত ঘোষ, আব্দুল মোমিন চৌধুরী, রাজু আহমেদ, শ্যামল বসাকের কারখানা উল্লেখযোগ্য।

এসব দই ও মিষ্টি ব্যবসায়ীরা বাংলানিউজকে জানান, স্বাভাবিক সময় এ উপজলায় প্রতিদিন প্রায় তিনশ থেকে তিনশ ৫০মণ দুধের চাহিদা থাকে। দুটি বাজার থেকে সর্বোচ্চ দুইশ থেকে দুইশ ৫০মণ দুধ পাওয়া যায়। ফলে প্রতিদিন প্রায় একশ থেকে একশ ৫০মণ দুধের ঘাটতি থেকে যায়। এই ঘাটতি মেটাতে পাশের ধুনট, সোনাহাটা, সোনামুখি, গোসাইবাড়ী, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে দুধ আমদানি করা হত। এতে এখানে সব সময় দুধের বাজার বাড়তি থাকত।

কিন্তু ২০ দলের টানা অবরোধ-হরতালের কারণে এই হিসাব উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে।

হোটেল সুপার সাউদিয়ার ব্যবস্থাপক আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে জানান, আগে প্রতিদিন তার প্রতিষ্ঠানে ২৫ থেকে ৩০মণ দুধের চাহিদা ছিল। বর্তমানে এ চাহিদা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আট থেকে ১০মণ।

একইভাবে রিংকি সুইটসের ব্যবস্থাপক খোকন বাংলানিউজকে জানান, অবরোধ-হরতালের কারণে ১০/১২মণের জায়গায় বর্তমানে তারা চার থেকে পাঁচ মণ দুধ কিনছেন।

বৈকালী অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মিন্টু জানান, তারা প্রতিদিন যেখানে ১৫/২০ মণ দুধ কিনতেন সেখানে এখন ৫/৬ মণ দুধ কিনছেন।

সম্পা দধিভাণ্ডারের ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার ঘোষ জানান, তাদের আগে প্রতিদিন ৪০/৪৫ মণ দুধের চাহিদা ছিল। বর্তমানে তারা চাহিদা অনুমান করে প্রতিদিনি ২০/২৫ মণ দুধ কিনছেন।

তারা জানান, কেবল ব্যবসা ধরে রাখতে এখনও সামান্য পরিমান দই-মিষ্টি তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শুধু কারখানা চালু রাখা হয়েছে মাত্র।

তবে দুধের দাম কমে আসলেও দই-মিষ্টির দাম কমেনি। স্থানীয় চাহিদার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ব্যবসায়ীরা দই-মিষ্টি তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে বাজারে এসব মিষ্টির সংকট থেকেই যাচ্ছে। যে কারণে দাম আগের মতই রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বাংলানিউজকে জানান, আপতঃ দৃষ্টিতে লোকসান মনে না হলেও উৎপাদনের দিক মাথায় রেখে হিসেব করলে দই ব্যবসায়ীরা ভাল নেই। উৎপাদন কমিয়ে আনায় ব্যবসায় প্রচণ্ড ক্ষতি হচ্ছে।

কেবল দুধের দাম কমেছে। বাকি সবকিছুর দাম আগের মতই রয়েছে। শ্রমিকদের মজুরিও আগের মতই গুণতে হয়। পাশাপাশি উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। সেই হিসেবে আয়ও নেমে এসেছে। এসব কারণে অনেক ছোট ব্যবসায়ী দই-মিষ্টি উৎপাদন আপতত বন্ধ রেখেছেন।

আগের দাম অনুযায়ী প্রতি সরা দই একশ ৩০ থেকে একশ ৪০টাকা, প্রতি পিচ গ্লাস দই ২৫ থেকে ৩০টাকা, পাতলা দই প্রতিমণ দুই হাজার দুইশ থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।

একইভাবে প্রতি কেজি কাটারিভোগ, ছানার মুড়কি ও রস কদম মিষ্টি তিনশ থেকে তিনশ ২০ টাকা, খিরসা ভোগ তিনশ ৬০ থেকে তিনশ ৮০টাকা, চমচম একশ ৯০ থেকে দুইশ ১০টাকা, ল্যানচা তিনশ ৬০ থেকে তিনশ ৮০টাকা, বরফি ও সন্দেশ তিনশ থেকে তিনশ ২০টাকা, সাধারণ বড় মিষ্টি একশ ৮০ থেকে দুইশ টাকা এবং সাধারণ ছোট মিষ্টি প্রতি কেজি একশ ৫০ থেকে একশ ৬০টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ সময়: ০১১০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ