ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদন

বাংলাদেশ-ভারতের ‘সিমেন্টের বন্ধন’

রাইসুল ইসলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৪
বাংলাদেশ-ভারতের ‘সিমেন্টের বন্ধন’

ঢাকা: বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ‌উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজ করলেও সত্যিই দুই দেশের সম্পর্ক কতদূর এগিয়েছে সে ব্যাপারে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে প্রখ্যাত সাময়িকী দি ইকোনোমিস্টে।

সোমবার ইকোনোমিস্টের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে লেখক টম ফেলিক্স জোয়েনক মেঘালয় সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের ছাতকে অবস্থিত লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা ভ্রমণের ছায়াকে আলেখ্য করে বিশ্লেষণ করেছেন দুই দেশের সম্পর্কের স্বরূপ।


 
প্রতিবেদনের প্রথমেই ব্যাপক উন্নয়নশীল বাংলাদেশের একটি চিত্র তুলে ধরে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের স্বল্পতার কথা তুলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে উঠে আসে সিমেন্ট তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল চুনাপাথরের স্বল্পতার বিষয়টি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দ্রুত নগরায়নের কারণে বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে বেড়ে গেছে সিমেন্টের চাহিদা। টান পড়েছে সিমেন্টের কাঁচামালে। যার চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হয় প্রতিবেশী ভারত সহ অন্যান্য দেশের ওপর।

সেই চাহিদা মেটাতেই নব্বই দশকের মাঝামাঝি ছাতকে লাফার্জের কারখানায় চুনাপাথর সরবরাহের জন্য ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে একটি আন্তঃসীমান্ত কনভেয়ার বেল্ট নির্মিত হয়। দুই দেশের সীমান্তে অবস্থিত ১৭ কিলোমিটার লম্বা এই কনভেয়ার বেল্ট থেকে ভারত থেকে চুনাপাথর আসে। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তঃসীমান্ত কনভেয়ার বেল্ট বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।   

প্রতিবেদনটি মূলত প্রতিবেদকের ওই সিমেন্ট কারখানা এবং কনভেয়ার বেল্টটি পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে রচিত। এরই ফাঁকে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণের চেষ্টা প্রতিবেদকের।
 
ঢাকা থেকে ছাতক যাওয়ার পথে প্রতিবেদকের চোখে ধরা পড়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রভাবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের চিত্র। সিলেট যাওয়ার পথে মহাসড়কের দু’ধারে যুক্তরাজ্য প্রবাসী সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দাদের নির্মিত সুন্দর সুন্দর ভবন প্রতিবেদকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।

প্রতিবেদকের জবানিতে-

‘ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে মাঝে উ‍ঁকি দেয় আলিশান ভবন। স্থানীয়ভাবে লন্ডনী নামে পরিচিত যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা এসব ভবনের মালিক। ‘

‘সিলেট শহরের পশ্চিম দিকে একটি ছোটো রাস্তা ধরে এগুলো মেঘালয়ের খাসি পাহাড় নজরে আসে। এই অঞ্চলের বার্ষিক মৌসুমী বৃষ্টিপাতের অধিকাংশই হজম করে এসব পাহাড়। পাশেই অবস্থিত সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের জন্য খ্যাত ভারতের চেরাপুঞ্জি। ওই পবর্তমালা বিধৌত বেশিরভাগ পানিই সুরমা নদী ধরে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পৌঁছায় বঙ্গোপসাগরে।

এই নদীর উত্তর পাশে ছাতকে স্থাপিত কনভেয়র বেল্টের বাংলাদেশ অংশ। যার একটি প্রান্ত শেষ হয়েছে ফরাসি-স্প্যানিশ সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লাফার্জ সুরমার মালিকানাধীন বিশাল একটি সিমেন্ট কারখানায়। কারখানা থেকে বের হওয়া সিমেন্টের ব্যাগগুলো বাকানো একটি ধাতব স্লাইড ঘুরে জমা হয় নদীতে রাখা বার্জে। যা রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

নদীর দক্ষিণ পাশে এক চায়ের দোকানদার বালক জানালো এখানে ব্যবসা ভালোই। তবে কিছুদিন আগেও পরিস্থিতি এমন ছিলো না। বছরখানেক কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে চুনাপাথর আসা বন্ধ ছিলো। পরিবেশের ক্ষতির কারণ দেখিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই খনিজ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে অবশ্য তা আর বজায় থাকেনি। ’

প্রতিবেদকের চোখে আরও ধরা পড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর উন্নয়নের চাহিদার কথা।

তার জবানিতে, ‘চায়ের দোকানের খরিদ্দাররা জানালেন, এখানে একটি ব্রিজ হলে ভালো হতো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে এখানে একটি সেতুর নির্মাণ শুরু হয়েছিলো, কিন্তু উত্তরসূরী শেখ হাসিনা এর কাজ শেষ করেননি। ফেরি পার হতে খরচ হয় ৩০ সেন্ট বা ২৫ টাকা। ফেরিঘাটে দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর মাত্র ৫ মিনিটেই আমরা অপর পাড়ে পৌঁছালাম। ‘

এর ফাঁকেই অাবার লাফার্জ সুরমার প্রসঙ্গ ফিরে আসেন প্রতিবেদক। সেখানে উঠে আসে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনার কথা।

তিনি বলেন, ‘নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় ১২ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন প্লান্টটি বানাতে খরচ হয় ২৮ কোটি ডলার। এটাই ছিলো তখন বাংলাদেশে সর্বোচ্চ একক সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ।   লাফার্জ সুরমা জানিয়েছে এই কারখানার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি বছর ছয় কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাচ্ছে। পাশাপাশি তারা সরকারকে বছরে এক কোটি ডলার কর দিচ্ছেন। এছাড়া তৈরি হয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান। বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় কোটি টন সিমেন্ট চাহিদার দশ ভাগের এক ভাগ মেটায় এই কারখানাটি। ’

লাফার্জের ওই কারখানার চিত্র তুলে ধরার প্রসঙ্গেই এবার প্রতিবেদক ঢাকা ও দিল্লির সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা এবং আসলে দুই দেশের সম্পর্কে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সে দিকে পাঠকের দৃষ্টি ঘোরান।

তার ভাষ্য অনুযায়ী, যদিও সীমান্ত হত্যা বন্ধ, পানি ভাগাভাগি চুক্তি এবং সিটমহল বিনিময় প্রভৃতি আরও অনেক অমীমাংসিত ইস্যুতে ইদানীং নিজেদের মধ্যে আশ্বাসবাণী বিনিময় করছেন দুই দেশের কূটনীতিকরা। কিন্তু অগ্রগতি খুব একটা হয়নি।

এছাড়া ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে ৪ হাজার ১শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত থাকলেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের লড়াইয়ে বাংলাদেশ যে আঞ্চলিক সহযোগিতা খুব কমই পেয়েছে এ বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রতিবেদকের মতে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মূল ভূমিকা পালন করে দেশের প্রবাসী ও পোশাক শ্রমিকরা। বাংলাদেশের প্রবাসীদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক। অপরদিকে পোশাক শ্রমিকদের বানানো পোশাকের মূল গন্তব্যস্থল ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংগ্রামে প্রতিবেশী দুই দেশের সংশ্লিষ্টতা তাই খুব একটা নেই বলেও উল্লেখ করেন প্রতিবেদক।
 
সবশেষে এই ১৭ কিলোমিটার লম্বা কনভেয়ার বেল্ট এবং দেশের পশ্চিম সীমান্তে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থাপিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রতিবেদকের বক্তব্য,  ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এই দুটি স্থাপনাই এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নির্মিত একমাত্র স্থাপনা।

মূলত এ বিষয়টিই নির্দেশ করে দুই দেশের সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়টি।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ