ঢাকা, শনিবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩২, ০৩ মে ২০২৫, ০৫ জিলকদ ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

উপকূল থেকে উপকূল

লবণচাষ: কৃষি নাকি শিল্প?

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৪২, মে ১৪, ২০১৪
লবণচাষ: কৃষি নাকি শিল্প? ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লোকসানে লবণচাষ। হাজারো চাষির জীবিকায় ধস।

রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। তবুও অবহেলা। চাষিরা উৎসাহিত হচ্ছে না। অথচ লবণখাতের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা যায় অনায়াসে। সম্ভাবনা বিকাশে বাধা পদে পদে। তৎপর সিন্ডিকেট চক্র। লবণের ন্যায্য দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা মধ্যস্বত্বভোগী। লুকোচুরি বড় ব্যবসায়ীদের। কারও ধারণা, লবণখাত কী পাটখাতের মত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে? এসব নিয়ে লবণ চাষ বিষয়ক ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব প্রকাশ হলো বুধবার।

বদরখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার: লবণ চাষের জন্য চড়া মূল্যে জমি বর্গা নিতে হয়। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমি তৈরি করতে হয়। তপ্ত রোদে পুড়ে মাঠের পরিচর্যা করতে হয়। চাষির শ্রমের পর অনুকূল পরিবেশ পেলে তবেই ভালো উৎপাদন। পণ্যটি উৎপাদিত হয় মাঠে, উৎপাদন করেন চাষি, প্রক্রিয়াটির নামও লবণ চাষ। তারপরও লবণ কৃষিপণ্য না শিল্পপণ্য তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

চাষিসহ লবণ চাষে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লবণ উৎপাদনের পর এটি শিল্প হিসাবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু উৎপাদন পর্যায়ে এটি কৃষি। উৎপাদন পর্যায়ে লবণকে কৃষিপণ্য হিসাবে গণ্য না করায় হাজার হাজার চাষি সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ধারদেনা করে লবণ চাষ করলেও কৃষক হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে না কোনো সুবিধা। তাদের কাছে বার বার এই প্রশ্নটিই ঘুরপাক খায়: লবণচাষ কৃষি নাকি শিল্প?   

লবণ উৎপাদনকে চাষ বলা হলেও মাঠে এই পণ্যটির উৎপাদনকারীরা সরকারের চাষি তালিকায় নেই। এর ফলে দেশের লবণ উৎপাদন এলাকা হিসাবে পরিচিত কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার অন্তত অর্ধলক্ষাধিক লবণ চাষি তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে চকরিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া এলাকার লবণ চাষিরা বাংলানিউজের কাছে এমনই অভিযোগ করেছেন।

কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তাবালর চর এলাকার লবণ চাষি মোবারক হোসেন বলেন, লবণ চাষ করলেও আমরা তো চাষির তালিকা নেই। ফলে চাষি হিসাবে সরকারি বেসরকারি কোন সহায়তা পাইনা। মহাজনদের কাছ থেকে ধারকর্জ এনে জমি বর্গা নিয়ে লবণ চাষ করি। লবণের দাম পেলে দেনা শোধ করতে পারি, আর না পেলে শোধ হয় না। দেনায় আটকে থাকি বছরের পর বছর।

চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়নের আজমপাড়ার চাষি মনির হোসেন, আইয়ূব আলী, সাইফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন চাষির সঙ্গে বাংলানিউজের দেখা মেলে গ্রামের ছোট্ট বাজারে ইউসুফ আলীর চায়ের দোকানে। আলাপের সময় ভিড় জমালেন লবণ চাষে সম্পৃক্ত আরও বেশকিছু মানুষ। সবার একই কথা, লবণ চাষ বলা হলেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত চাষিরা কোনো সহায়তা পায় না। লবণকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করায় এর সুবিধা পাচ্ছে শিল্পপতিরা। তারা তো লবণ চাষির দিকে ফিরেও তাকায় না।

লবণ চাষিরা বলছেন, মাঠে আর দশটি পণ্য উৎপাদনের মত লবণ চাষেও রয়েছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক ঝুঁকি। সময়মত ভালো রোদ পাওয়া না গেলে কিংবা অকালে বৃষ্টি হলে লবণ চাষিরা সব হারায়। পুরো মৌসুমের চেষ্টা বিফলে যায়। আবার কখনো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে লবণ চাষিদের সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। লবণের ভরা মৌসুমে জোয়ার-ভাটার অস্বাভাবিক আচরণে চাষিরা ঠিকমত লবণ পানি পায় না। এ কারণে অনেক মৌসুমে বর্গা চাষিরা নিজেদের শ্রমের খরচটুকুও ঠিকমত ঘরে তুলতে পারে না।

এত ঝুঁকির পরও লবণকে কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচনা না করায় তারা কোন ধরনের সহায়তা পায় না। প্রান্তিক চাষিরা সরকারি-বেসরকারি সুবিধা পাওয়া তো দূরের কথা, লবণের ন্যায্যমূল্যটাই পায় না। চাষি হিসাবে তারা দাবিও তুলতে পারছেন না। কারণ সরকারের তালিকায় তো তাদের চাষি স্বীকৃতি নেই।

চকরিয়া উপজেলার বেশকিছু এলাকায় পরিবেশ ও জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তামাক চাষের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চাষিদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়ে তামাক চাষ সম্প্রসারণ করছে। অথচ দেশের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম একমাত্র দেশীয় পণ্য লবণ উৎপাদনে চাষিদের জন্য কোন সুবিধা নেই।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতি সূত্র বলছে, লবণ মাঠ পর্যায়ে চাষ হলেও একে শিল্প পর্যায়ে রাখায় চাষিদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আর এই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লবণকে মাঠ পর্যায়ে কৃষি ও উৎপাদনের পর শিল্পপণ্য হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য বিসিকের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। তবে বিসিক এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি এইচ এম শহীদ উল্লাহ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, চাষিদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে লবণকে দুটো পর্যায়ে ভাগ করতে হবে। মাঠে কৃষি হিসেবে উৎপাদনের পর এটি কারখানায় গিয়ে শিল্প হিসাবে বিবেচিত হবে। তাহলে চাষি লাভবান হবে। তারা কৃষিঋণের সুবিধা পাবে। আবাদ সময়ে চাষিদের হাতে টাকা না থাকায় তারা মহাজনের কাছে হাত পাতে। এই সুযোগে লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগীরা।

লবণ চাষি সমিতির সাবেক নেতা এফ এম নূরুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, লবণকে কৃষিপণ্য হিসাবে আখ্যায়িত না করায় কৃষকরা মাত্র পাঁচ-দশ হাজার টাকা কৃষিঋণ থেকেও বঞ্চিত হয়। এটা মূলত কৃষিপণ্য। লবণ মিল মালিকরা এটাকে শিল্প পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এতে তারাই লাভবান হচ্ছে। তারা শিল্প দেখিয়ে সরকার থেকে মোটা অংকের ঋণ পায়। অথচ চাষিরা পায়না কিছুই।

তবে এই প্রশ্নে কৃষি বিভাগ ভিন্নমত পোষণ করেছে। চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আতিকুল্লাহ বলেন, লবণ চাষ কৃষি বিভাগের আওতায় আসতে পারে না। কারণ উৎপাদিত পণ্যটা শিল্পপণ্য।    
 
বৃহস্পতিবার পড়ুন: সক্রিয় সিন্ডিকেট: ধ্বংসের দ্বারে লবণখাত


** চোখের জলে লবণ চাষ!

** লবণচাষে সম্ভাবনা, তবুও অবহেলা


[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবরটি বাংলানিউজে দেখতে চান? মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

 

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪১ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

অর্থনীতি-ব্যবসা এর সর্বশেষ