ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

আমি রাতের প্রহরী…

মেহেদী হাসান পিয়াস, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৪
আমি রাতের প্রহরী… ছবি: দেলোয়ার হোসেন বাদল/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: মাঝরাত, অন্ধকার গলির ভেতর মলিন ল্যাম্প পোস্টটিই যা দেখা যাচ্ছে। গলির আরেক মাথা থেকে মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে বাঁশির চিৎকার।

দূরে কোথাও একটা কুকুর ঘেও ঘেও বকে যাচ্ছে। তার মাঝে কেউ একজন হাঁক দিচ্ছেন দুর্বোধ্য শব্দে। এছাড়া বাকি সবটাই নীরবতা।
 
চৈত্রের টানা গরমের পর কয়েক পশলা বৃষ্টি নগর জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় তাই ঘুমে অচেতন নগরবাসী।
 
ঘিঞ্জি এ গলির মুখ ধরে কিছুদূর এগুতেই অন্ধকারে দেখা মিলল খর্বকায় একজনের সঙ্গে। তার গলায় ঝুলানো বাঁশি, একহাতে টর্চলাইট আরেক হাতে বড়জোড় দেড়হাত লম্বা একটা সুঠাম লাঠি। সামনা-সামনি হতেই বাঁশিতে ফুৎকার দিলেন। মুহূর্তেই রাতের সবটুকু নীরবতা ভেঙে খান খান।
 
টর্চ লাইটটা ধরলেন আমাদের শরীরের মাঝখানে। পোশাক-পরিচ্ছেদে ভদ্রলোক বুঝতে পেরে সালাম দিলেন। সালামের প্রতি উত্তর দিয়ে বললাম, মামা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? কিছুটা ইতস্তত হয়েই বললেন, বলুন?
 
সাংবাদিক পরিচয় দিয়েই কথা শুরু করলাম। জানতে চাইলাম অনেক কিছু! নির্মোহ, নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিতে বললেন যা যা চানতে চেয়েছি।    
 
জানালেন, শীত, গরম, ঝড়, বৃষ্টি, আলো, অন্ধকার যে পরিস্থিতিই থাকুক না কেন সারা বছর রাত জেগে মহল্লার দোকানপাট, বাসা-বাড়ি পাহারা দেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিরাতেই এভাবে নিরাপদ ঘুম ফেরী করে বেড়ান এ গলি থেকে ও গলি।
 
শুক্রবার দিনগত রাত দেড়টার দিকে রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় মহল্লার এক গলির ভেতরে কথা হয় নৈশ প্রহরী সুন্দর আলীর সঙ্গে।
 
আলাপচারিতায় জানা গেলো, তার বর্তমান বয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন। দীর্ঘ এগার বছর ধরে একাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। পারিশ্রমিক হিসেবে মাস শেষে পান তিন থেকে চার হাজার টাকা।

কোনো কোনো মাসে পাঁচ হাজার টাকাও পেয়ে থাকেন। তবে সেটা কারো দয়া-দাক্ষিণ্যের কল্যাণে।
night_gurd_1
দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক সুন্দর আলী মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৫ বছর বয়সে ঢাকায় আসেন নরসিংদীর ভরতের কান্দি গ্রাম থেকে। শুরুতে নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে জোগালি  কাজ করতেন।

সংসার শুরু করার পরও বছর দেড়েক এই কাজই করেছেন। এরই মধ্যে সংসারে আসে নতুন মুখ।
 
স্বাভাবিকভাবেই চাহিদা বেড়ে যায় সংসারের। বাড়তি উপার্জনের আশায় সারাদিন জোগালি হিসেবে কাজ করার পর রাতে রিকশা চালাতে শুরু করেন সুন্দর আলী।

এভাবে চলে আরো কয়েক বছর। এরমধ্যে আরো দুই সন্তানের আগমন ঘটে সংসারে। ভরণ-পোষণ মিলিয়ে চাহিদার মাত্রা সামর্থকে ছাড়িয়ে যায় সুন্দর আলীর।
 
কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। চিন্তা একটাই উপার্জন বাড়ানো যায় কীভাবে! পরিশ্রমের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। আয়-উপার্জন বাড়াতে স্ত্রীকেও যুক্ত করেন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে।

উপার্জন কিছুটা বাড়লেও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন স্ত্রী মাজেদা। হাতুড়ে চিকিৎসায় মাজেদা সুস্থ হয়ে ওঠার পর আর কাজে যুক্ত হতে পারেননি। ফলে সংসারের ঘানি আবার একাই টানতে শুরু করেন সুন্দর আলী।
 
ছেলে-মেয়ে তিনটা একটু বড় হওয়ার পর স্ত্রী মাজেদা এবার বাসা-বাড়িতে কাজ নিলেন। দুজনের উপার্জনে চলছিলও বেশ। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু এ অবস্থারও টেকসই হলো না বেশিদিন। এবার সুন্দর আলী নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়েই জোগালির কাজ ছেড়ে দিতে হলো।
 
এবার দিন-রাত মিলিয়ে রিকশা চালান। কিন্তু তাতে কিছুতেই চলছিল না তাদের। এরইমধ্যে পরিচয় হয় পাশের মহল্লার নৈশ প্রহরী সিরাজ মিয়ার সঙ্গে। তার পরামর্শেই রাতে রিকশা চালানো বাদ দিয়ে শুরু করেন নৈশ প্রহরীর কাজ। এরপর থেকে টানা ১১ বছর...।
 
প্রথম কয়েক বছর মাসে এক-দুই হাজার টাকা পেতেন। এরপর থেকে আস্তে আস্তে আয় বাড়তে থাকে। এখন আরেকজনের সঙ্গে নিজেদের মতো করে সীমানা ভাগ করে তালিকা তৈরি করে নিয়েছেন। ফরে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তার।
 
সুন্দর আলী জানালেন, ছেলেটা একটা গার্মেন্টসে কাজ করে চার হাজার টাকা পায়। আর এ কাজ করে তার যা উপার্জন তাই দিয়ে চলছে সংসারের যাবতীয় খরচ।
night_gurd_2
দিনে কতক্ষণ ঘুমান? জানতে চাইলে সুন্দর আলী বলেন, দিনে তিন-চার ঘণ্টা ঘুমাই। দিনে কি আর এত ঘুম হয়?
 
রাতে ঘুম ধরে না? সুন্দর আলীর সাবলীল উত্তর, না, অভ্যাস হয়ে গেছে।
 
কথা শেষ করে বিদায় নিয়ে সোজা চলে এলাম কুড়িল চৌরাস্তায়। সিএনজি থামিয়ে চা পান করছিলাম। এমন সময় দূর থেকে ভেসে এলো সেই একই শব্দ। কৌতূহল নিয়ে কাজী বাড়ি মসজিদ রোড ধরে সামনে এগুতে থাকলাম।
 
কিছুদূর যেতেই দেখা গেল প্রায় বৃদ্ধ একজন বসে আছেন ঝাঁপ ফেলানো একটি দোকানের সামনে। তার গলাতেও বাঁশি ঝুলানো। পাশেই রাখা আছে লাঠি ও একটি ছাতা। বুঝতে অসুবিধা হলো না। কাঁধের গামছা দিয়ে প্রতিনিয়ত মশা তাড়াচ্ছেন এই বৃদ্ধ।
 
কথায় কথায় বৃদ্ধ জানালেন তার নাম মো. সোলায়মান। ১৪ বছর ধরে এ এলাকায় নৈশ প্রহরীর কাজ করছেন। এর আগে রাজধানীতে সিটি বাস সার্ভিসে এবং নাবিস্কো বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে গাড়ি চালাতেন। তার আগে টানা ২৪ বছর বিআরটিসি বাসের চালকের চাকরি করেছেন।
 
সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিষোদগার করতে করতে বললেন, ১৯৯৩ সালে ড্রাইভার, স্টাফসহ বিআরটিসির ১৩২০ জনকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে বাধ্যতামূলক ছাঁটাই করা হয়। সেই থেকে ক্ষোভ। তার মতে, তৎকালীন খালেদা জিয়া সরকার বিআরটিসি সার্ভিসকে ধ্বংস করেছে।  
 
মো. সোলায়মান জানান, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ওই সময় ভারতের আগড়তলায় গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম নেই তার। সে নিয়ে আক্ষেপও নেই বৃদ্ধ সোলায়মানের।
 
কিন্তু পান চিবুতে চিবুতে কিছুটা হাসি মাখিয়ে যখন বললেন, যুদ্ধ কইরা দেশ বাঁচাইসি, অহন রাত পাহারা দেই, নৈশ প্রহরী।

 তখন ঠিক বুঝা গেল না কথাটার অভিব্যক্তিতে ক্ষোভ নাকি গৌরব ছিল!
 
এই বয়সে রাত জাগতে কষ্ট হয় না? জানতে চাইলে তিনি জানান, কষ্ট হয় না আবার, মশার কারণে কোনো জায়গায় এক মুহ‍ূর্ত বসা যায় না। সারারাত পায়চারী করতে হয়। সারাদিন ঘুমাইলেও রাইতের ঘুমের তৃপ্তি হয় না।
 
বৃদ্ধ সোলায়মানের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মনে পড়ে গেল ‘রাতের প্রহরী’ শিরোনামে তরুণ কবি অতনু তিয়াসের লেখা ও সুর করা গানটি।

গানের কথাগুলো এরকম,
 
‘আমি রাতের প্রহরী, আমি রাতের প্রহরী
বল্লম হাতে নিয়ে, বাঁশিতে জানান দিয়ে
নিরাপদ ঘুম ফেরী করি..... ॥
 
......................................

সবাই যখন ঘুমে অচেতন আমি জেগে আছি রাস্তায়
জীবনটাকে বিকিয়ে দিলাম জলের দামে সস্তায়।
আমার পাওনা ছিল চোখভরা ঘুম
কে শোনে ক্লান্ত আহাজারী!
 
আমি রাতের প্রহরী....!

বাংলাদেশ সময়:০৭০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ফিচার এর সর্বশেষ