৩৭ বছর বয়সে এসেও ইউরোপের সেরা মঞ্চে নায়ক ফ্রান্সেস্কো আচেরবি।
এই গল্প শুধু ফুটবলের নয়।
শেষ মুহূর্তে গোল, ইন্টারকে দিলেন দ্বিতীয় জীবন
২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে বার্সেলোনার বিপক্ষে ৯৩তম মিনিটে আচেরবির দুর্দান্ত গোল ইন্টারকে সমতায় ফেরায়। অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচ গড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত তারা দুই লেগ মিলিয়ে ৭–৬ ব্যবধানে জয়ী হয়।
তাতেই ইতিহাস গড়েন আচেরবি। এটি ছিল তার ইউরোপিয়ান ক্যারিয়ারের ৬৫ ম্যাচে প্রথম গোল—দুর্বল ডান পায়ে, আর সারা ম্যাচে প্রতিপক্ষের বক্সে মাত্র একবার বল ছুঁয়ে!
ইন্টারে তার সতীর্থ কার্লোস আগুস্তো বললেন, “আচে আমাদের সবাইকে সাহস দেখিয়েছে। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও তার গল্পটা দারুণ অনুপ্রেরণার। ”
অন্য সতীর্থ স্তেফান দে ফ্রেই বললেন,
“ও একজন ডিফেন্ডার হলেও গোলটা করেছে যেন প্রকৃত একজন স্ট্রাইকার। ওর মধ্যে কিছু জাদুকরী আছে। ”
সিংহের গল্প: ভয়ে শুরু, শেষে বিজয়
ভিজ্জোলো প্রেদাবিসি নামের ছোট্ট গ্রামে জন্ম আচেরবির। ছোটবেলা থেকেই এসি মিলানের সমর্থক ছিলেন, ২০১২ সালে সেই ক্লাবেই সুযোগ পান। কিন্তু সেই স্বপ্নপর্বেই হানা দেয় ট্র্যাজেডি—বাবার মৃত্যু। তিনি ছিলেন আচেরবির জীবনের প্রথম অনুপ্রেরণা, আবার কঠোর সমালোচকও। আচেরবির নিজের ভাষায়,
“তিনি আমাকে ভালোবাসতেন, কিন্তু সেই ভালোবাসা অনেক সময় ব্যথা দিত। ”
বাবার মৃত্যু তাকে নিক্ষেপ করে বিষণ্নতা আর অ্যালকোহলের অতল গহ্বরে।
"অনুশীলনে যেতাম আগের রাতের নেশা না কাটিয়েই। আমি শুধু শারীরিক শক্তির ওপর ভরসা করতাম,"
—বলেছেন আচেরবি।
দুইবার ক্যান্সার, কিন্তু একবারও হার নয়
২০১৩ সালে আচেরবির শরীরে ধরা পড়ে টেস্টিকুলার ক্যান্সার। অপারেশনের পর মাঠে ফিরলেও কয়েক মাসের মধ্যে ক্যান্সার ফিরে আসে। শুরু হয় কেমোথেরাপি।
“হঠাৎ একদিন আপনার জীবন বদলে যায়, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়,”
—এভাবেই স্মরণ করেন সেই সময়।
তবে আচেরবি হাল ছাড়েননি। চিকিৎসা নেন, নিজের মনের সঙ্গে লড়েন, এবং ফিরে আসেন মাঠে।
“এই ক্যান্সারই আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে। আমি কে, আমি কী চাই—তা নতুন করে বুঝতে শিখেছি,” বলেছেন আচেরবি।
ফুটবলে পুনর্জন্ম, নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠা
সাসসুয়োলোতে নিজের জায়গা পোক্ত করেন আচেরবি। ২০১৮ সালে যোগ দেন লাজিওতে, যেখানে কোচ সিমোনে ইনজাগির অধীনে তিনি ফের নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পান।
২০২২ সালে ইনজাগির অনুরোধে আচেরবিকে ইন্টার মিলানে নিয়ে আসে ক্লাব। যদিও ভক্তদের মধ্যে ছিল সন্দেহ—একসময় এসি মিলানের খেলোয়াড় বলে।
কিন্তু আচেরবির নেতৃত্ব, মনোযোগ আর লড়াইয়ের মানসিকতা সব শঙ্কা ভুল প্রমাণ করে। ইনজাগি বলেন,
“আচেরবির মতো মনোযোগী আর সাহসী খেলোয়াড় কমই দেখেছি। সে মাঠে যা দেয়, তা দলকে বাঁচিয়ে তোলে। ”
আচেরবির আত্মপরিচয়
আচেরবির শরীরে আঁকা একাধিক উল্কিতে ফুটে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব। বুকের ওপর লেখা—“The Lion King”, পেট জুড়ে গর্জনরত সিংহ, ডান বাহুতে কার্টুন লায়ন 'অ্যালেক্স', আর পিঠে আঁকা ডানা।
“সিংহের মতো আমি হার মানি না। জীবনে কতবার পড়েছি, কিন্তু প্রতিবার উঠেছি। নিজেকে সাহায্য করতে শিখেছি। চারপাশের মানুষ যদি ভালোবাসে, সেটার মূল্য বুঝতে হয়, কিন্তু শুরুটা সবসময় নিজের ভেতর থেকে করতে হয়,”
—বলেছেন আচেরবি।
ইতিহাসের সামনে আচেরবি, আরও একবার
২০২৩ সালের ইস্তানবুলে ইন্টার হেরে গিয়েছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। এবার মিউনিখে আবার সেই সুযোগ—আচেরবির হাত ধরে।
একসময় জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া আচেরবিকে আবার দলে ডেকেছেন কোচ লুচিয়ানো স্পালেত্তি, যিনি একসময় বলেছিলেন,
“আচেরবি? ওর বয়স কতো জানেন?”
উত্তর দিয়েছেন আচেরবি নিজেই—মাঠে, পারফরম্যান্সে, আর সবচেয়ে বড় কথা—আত্মবিশ্বাসে।
এমএইচএম