সেই তরুণ আর কেউ নন, ব্রাজিলের মহাতারকা এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু, যাকে সারা দুনিয়া চেনে ‘পেলে’ নামে।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ অনেক ক্ষেত্রেই নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে হাজির হয়।
১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের আগে প্রতিটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে প্রথম রাউন্ড থেকে শুরু করে ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা ছিল সেলেকাওদের। নিজদের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের চতুর্থ আসরের ফাইনালে দুই লক্ষ দর্শকের সামনে মারাকানা স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের একদম কাছে চলে গিয়েছিল সেলেকাওরা। দেশটির সব পত্রিকায় খেলা শেষ হওয়ার আগেই ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে বসে।
রিও কার্নিভ্যাল একদম তৈরি করাই ছিল। কিন্তু উরুগুয়ে সেবার কোটি কোটি ব্রাজিলিয়ানের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে ২-১ গোলে ফাইনাল জিতে ঘরে নিয়ে যায় শিরোপা। শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো ব্রাজিল জুড়ে। এরপর সুইজারল্যান্ডের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব ঠিকঠাক পেরোতে পারলেও কোয়ার্টার ফাইনালে সে সময়ের দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দল হাঙ্গেরির মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। সেই ম্যাচের আগের দুই ম্যাচে হাঙ্গেরি ১৭ গোল করেছিলো। ব্রাজিল আর হাঙ্গেরির ম্যাচটিকে বলা হয় সবচেয়ে ‘ভায়োলেন্ট’ ম্যাচ। তিন লাল কার্ড, দুই পেনাল্টি, আর ৬ গোল। ৪-২ গোলে ম্যাচ জিতে হাঙ্গেরি। তবে ম্যাচটি সবাই মনে রেখেছে পুরো ম্যাচে প্রতিপক্ষের সাথে হাতাহাতি আর টানেলে খেলোয়াড়দের মারপিটের কারণে। সেবার আবারও খালি হাতেই ফিরে যায় ব্রাজিল।
১৯৫৮ সালে প্রায় আনকোরা এক দল নিয়ে সুইডেনে হাজির হয় সেলেকাওরা। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর সুইডেন দুই দলই হলুদ জার্সি গায়ে মাঠে নামে। দেশ দুটি বিশ্বকাপে সাতবার একে অন্যের মুখোমুখি হয়েছিলো। কিন্তু সেবার ফাইনাল দিয়েই এই ঘটনার সমাপ্তি ঘটে। বরাবরের মতোই ফেবারিট হিসেবেই মাঠে নামে সেলাকাওরা।
বিশ্বকাপ জেতার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রস্তুতি নিয়ে সুইডেনে হাজির হয় দলটি। বাড়তি প্রস্তুতি দল থেকেই মিটিয়ে নেয়ার জন্য যা দরকার তার সবই উপস্থিত ছিল দলের সাথেই। কোচ ভিনসেন্ট ফিউলা নিজেই একজন সুপারভাইজার, একজন চিকিৎসক, একজন ডেন্টিস্ট, একজন ট্রেনার, একজন মনোবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। দলের জন্য সঠিক হোটেল নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় দলের মূল চিকিৎসক হিলটন গসলিংয়ের কাঁধে।
কথিত আছে, খেলোয়াড়দের মনোযোগে ঘাটতি হতে পারে এই ভয়ে হোটেলের সকল নারী কর্মীদের বদলে পুরুষ কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। এখানেই অন্য দলের সাথে ব্রাজিলের পার্থক্য চোখে পড়ে। জেতার জন্য উন্মুখ একটা দলে পেলে আর গ্যারিঞ্চার মতো তখনও বিশ্বের কাছে অজানা দুই ফুটবলারের যুক্ত হওয়া, যাতে প্রতিপক্ষের জন্য খেলাটা কঠিন করে তোলা যায়।
ব্রাজিল দলের কোয়ালিটি আগের সব সময়ের চেয়ে ভিন্ন রূপে হাজির হয় সুইডেন বিশ্বকাপে। রক্ষণভাগে অভিজ্ঞ অধিনায়ক হিলডারেলডো বেল্লিনির নেতৃত্বে জালমা সান্তোস এবং নিল্টন সান্তোস। মিডফিল্ড সাজানো হয় দারুণ মেধাবী ফুটবলার দিদির নেতৃত্বে। আর আক্রমণভাগে পেলে আর গারিঞ্চার সাথে ভাভা। ১৯৭০ সালের পূর্বে এই দলটিকেই ব্রাজিলের সেরা বলা হয়।
গোথেনবার্গে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে জয়ের ম্যাচে ভাভার দুই গোল ব্রাজিলের উত্থানের ইঙ্গিত দিয়েই রেখেছিলো। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম গোলের দেখা পান পেলে। ওয়েলসের বিপক্ষে সেই ম্যাচে গোল করার পর গোলবারের জালে ছুটে যাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করে স্থানীয় দর্শক। তবে পেলে তার ঝুলি খোলেন সেমিফাইনালে গিয়ে। প্রথমার্ধে ভাভা আর দিদির দুই গোলের পর দ্বিতীয়ার্ধে হ্যাট্রিক করেন পেলে। মাঠে উপস্থিত সুইডিশ দর্শকদের মুখের হাসি সেদিনই মিলিয়ে যায়। ফ্রান্সের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৫-২ গোলে জয় পায় ব্রাজিল।
স্টকহোমের ফাইনালে স্বাগতিক সুইডেন আর ব্রাজিল মুখোমুখি হয়। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে দুই দলের জার্সি নিয়ে। দুই দলেরই জার্সির রং হলুদ। এর জন্য আলাদা ড্র অনুষ্ঠিত হয়। স্বাগতিক সুইডেন তাতে জিতে যায়। ফলে হলুদ জার্সি ছেড়ে নীল জার্সি গায়ে মাঠে নামতে হয় ব্রাজিলকে।
সব ঠিকঠাক। জুনের ২৯ তারিখে মাঠে নামে ব্রাজিল-সুইডেন। স্বাগতিক হওয়ার ফায়দা নিতে প্রস্তুত সুইডেন মাঠের পাশে চিয়ার লিডারের ব্যবস্থা করেছিল যাতে ব্রাজিল দলের খেলায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু ব্রাজিল দলের অভিযোগে তা প্রত্যাহার করা হয়।
খেলা শুরু হওয়ার মাত্র চার মিনিটেই সুইডিশ অধিনায়ক লাইদহোম ব্রাজিলের ডিফেন্সকে ফাঁকি দিয়ে গোল করে বসেন। পুরো মাঠ যেন গর্জে উঠে। কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই সব উচ্ছ্বাস থামিয়ে দিয়ে গোল করেন ব্রাজিলের ভাভা। প্রথমার্ধের ৪৩ মিনিটে আরও এক গোল করে সুইডিশ দর্শকদের নিরব করে দেন ভাভা। ২-১ গোলে শেষ হয় প্রথমার্ধ।
দ্বিতীয়ার্ধে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠে ব্রাজিল। এবার গোলের দেখা পান পেলে। ৫৫ মিনিটে তার করা গোলের পর ৬৮ মিনিটে গোল করেন ব্রাজিলের জাগালো। সুইডেনের সিমনসন ৮০ মিনিটে একটা গোল শোধ করলেও তাতে ব্যবধান কমানো ছাড়া কোন কাজে লাগেনি। সুইডেনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন পেলে। ৯০ মিনিটে করা তার এই গোলের পর ৫-২ ব্যবধানে বিশ্বকাপের ট্রফিতে প্রথম চুম্বন আঁকার সুযোগ পায় সেলেকাওরা।
স্টকহোমের রাসুন্দা স্টেডিয়ামে স্বল্পসংখ্যক ব্রাজিলীয় পতাকা উড়ছিলো যার রং আবার হলুদ। কিন্তু মাঠে যে হলুদ জার্সির ফুটবলাররা মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ছে সেই দলটি মোটেই ব্রাজিল নয়। বরং নীল রঙের জার্সিতে পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করতে থাকা, আনন্দঅশ্রুতে চোখ ভিজিয়ে ফেলা দলটিই ব্রাজিল। বারবার বিশ্বকাপের মঞ্চে খালি হাতে ফেরা এই দলটি প্রথম শিরোপার স্বাদ পাওয়ার পাশাপাশি জানান দিয়ে গেলো আগামীতে ফুটবল বিশ্বে রাজত্ব করতেই এসেছে তারা।
পেলে নামের এক কিশোরের উত্থানও দেখলো বিশ্ব, যার হাত ধরে ব্রাজিলের ঝুলিতে উঠেছে আরও দুই বিশ্বকাপ। যে তরুণ একদিন হয়ে উঠেছিলো ব্রাজিলের জাতীয় দলের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও তিনবার বিশ্বকাপ জয়ী একমাত্র ফুটবলার।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, ২৯ মে, ২০১৮
এমএইচএম/এমএমএস