ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

পদ্মাসেতুর বদৌলতে বলাকইড় বিলে বেড়েছে দর্শনার্থী

একরামুল কবীর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০২২
পদ্মাসেতুর বদৌলতে বলাকইড় বিলে বেড়েছে দর্শনার্থী

গোপালগঞ্জ: গোপালগঞ্জের বলাকইড় পদ্মবিলের রাশি রাশি পদ্মফুল প্রকৃতিপ্রেমীদের মাঝে আভা ছড়াচ্ছে। বিশাল বিলে অসংখ্য গোলাপী পদ্মের সমাহার দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করছে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত দর্শনার্থী এখানে ছুটে আসছেন বিলের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ইট পাথরের যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হতে নানা বয়সের মানুষের এ যেন এক মিলন মেলা।

সূর্য়ের আভা ছাড়ানোর আগেই দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। সন্ধ্যা অবধি পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব আর প্রেমিক প্রেমিকারা ছোট বড় নৌকায় করে ভেসে বেড়ান প্রকৃতির এ অপরূপ সৃষ্টির মাঝে।

বিলে যত দূর দৃষ্টি যাবে দেখা মিলবে সবুজের মাঝে মাথা উঁচুক করে থাকা গোপালী পদ্ম। সেই সঙ্গে পদ্ম পাতার ওপর ও জলরাশিতে দেখা মিলবে সোলালী ব্যাঙ, ঘাস ফোডিং ও মাছের। দেখা মিলবে মৌমাছি দলের মধু সংগ্রহের জন্য এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেড়ানো। কিছুটা সময়ের জন্য এ যেন অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়া। আর অনিন্দ্য সৌন্দর্যের জলজ ফুলের রাণী পদ্ম মনের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা যে যার মতো করে এ বিলের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছেন আর ফ্রেমবন্দি করে রাখছেন। প্রতি বছরই প্রকৃতিকভাবে এখানে পদ্মফুল জন্ম নেয়। আর পদ্মা সেতু হওয়ায় ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুরসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন জেলা থেকে খুব সহজে ও অল্প সময়ের মধ্যে ভ্রমণপিপাষুরা চলে আসতে পারেন এ বিলে। নৌকায় ঘুরে উপভোগ করেন পদ্ম বিলের চোখ জড়ানো সৌন্দর্য। কিন্তু এখানে দূর দূরান্ত থেকে আসতে কিছুটা সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। তাই এখানে আসার সড়কটি প্রশস্ত ও পাকাকরণ এবং সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণসহ এখানে মৌসুমি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন দর্শনার্থীরা।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের বিলবেষ্টিত গ্রাম বলাকইড়। জেলা শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রাম। আর ইতোমধ্যে পদ্মবিলের কারণে গ্রামটি দেশ জুড়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। ১৯৮৮ সালে বন্যার পর থেকে বর্ষাকাল এলেই বিলের অধিকাংশ জমিতে প্রাকৃতিকভাবে পদ্মফুল জন্মে থাকে। আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বলাকইড় পদ্মবিলে ফুল থাকে। এ সময় পুরো বিল গোলাপী আর সাদা রংয়ের পদ্মফুলে ভরে ওঠে। তবে সাদা রংয়ের পদ্ম কিছুটা কম দেখা যায়। পদ্ম যেন এই এলাকার জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিলে ঘুরতে আসা শত শত দর্শনার্থীদের নৌকায় ঘুরিয়ে কর্মহীনরা উপার্জন করতে পারছেন। এ উপার্জনের ওপর নির্ভর করে চলে অন্তত শতাধিক পরিবার। তবে, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার দর্শনার্থীদের চাপ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় তাদের হিমশিম খেতে হয়। এ তিন দিনে দেখা দেয় নৌকার সংকট। অনেক দর্শনার্থীকে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ না করেই ফিরে যেতে হয়। তবে সে সময় স্থানীয়রা তাদের ব্যক্তিগত নৌকা দিয়ে সহযোগিতা করেন। তারপরেও দর্শনার্থীদের তুলনায় সেটি অপ্রতুল।

এদিকে নৌকা সংকটের সুযোগে কেউ কেউ অল্প সময় ঘুরিয়ে বেশি টাকা নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন দর্শনার্থীরা। তারা বলেন, এখানে নৌকার মালিকরা একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তারা বন্ধের দিন দর্শনার্থী বেশি হওয়ায় বাড়তি আয়ের আশায় ২৫-৩০ মিনিট ঘুরিয়ে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে বেশি নেন। তাতে দর্শনার্থীরা মন ভরে পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন না। বিষয়টির দিকে প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন তারা।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে ঘুরতে আসা আশরাফুল ইসলাম বলেন, আগে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে একটা নৌকা ভাড়া করলে সকাল থেকে দুপুর বা বিকেল পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো যেত। আর এখন জনপ্রতি ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়। তারপরেও আধা ঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট ঘুরিয়ে নৌকা থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এতে ভালোভাবে বিল ঘুরে দেখা যায় না। গোপালগঞ্জ শহরের মেহজাবীন ‍মুক্ত বলেন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পদ্মবিল ঘুরতে এসেছি। বিলের সৌন্দর্য দেখে আমি বিমোহিত। বাচ্চারাও উপভোগ করেছে পদ্মবিলের সৌন্দর্য। সবারই এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা উচিত। তাহলে কিছু সময়ের জন্য হলেও মন ভালো হয়ে যায়। তবে এখানে নৌকার সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। তাহলে দূর দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা আরও ভালভাবে বিলটি উপভোগ করতে পারবেন। আশা করবো প্রশাসন এ বিষয়টিতে নজর দিবেন। আর তা না হলে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে যেতে পারে।

ঢাকার সুমাইয়া আক্তার বলেন, পদ্মবিলের খবর শুনে পরিবার পরিজন নিয়ে আমরা এখানে এসেছি। জায়গাটি সত্যিই অপূর্ব। এর সৌন্দর্য আসলেও দেখার মতো, মন ভরে উপভোগ করার মতো। তবে এই পদ্মবিলকে ঘিরে একটি মৌসুমি পর্যটন কেন্দ্র করা যায়, তাহলে এখানে দেশ বিদেশ থেকে অনেকে ঘুরতে আসতে পারেন। তাতে এখানকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ভ্রমণপিপাষুরাও স্বচ্ছন্দে ঘুরতে পারবেন।

ঢাকার কামরাঙ্গির চরের নাহিদা সুলতানা বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে আমরা খুব সহজে এখানে আসতে পেরেছি। নৌকার করে পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। দেখার মতো এখানকার সৌন্দর্য। কারণ এটা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি। আর এতো বড় পদ্মবিল আর ফুল কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি আমার পরিচিত সবাইকে বলবো এখানে আসতে। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার করপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, বলাকইড় পদ্মবিলে সুখ্যাতি এখন দেশ জুড়ে। প্রতিদিনই এখানে শত শত দর্শনার্থী আসছেন। তবে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে থাকে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। এখানে আসা অধিকাংশ দর্শনার্থী প্রচুর পরিমাণ ফুল ছিড়ে নিয়ে যান। এতে বিলের সৌন্দর্য হারাচ্ছে আর ফুলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আবার অনেকে খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ বিলের মধ্যে ফেলে পরিবেশ নোংরা করেন। সবাইকে বিলের সৌন্দর্য রক্ষায় এসব থেকে বিরত থাকা উচিত।

পদ্মবিল পাড়ের বাসিন্দা ও নৌকার মাঝি আয়নাল ঢালী বলেন, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার এখানে অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন। ছুটির দিনগুলোতে নৌকার সংকট পড়ে যায়। তারপরেও আমরা সবাইকে বিলের সৌন্দর্য ঘুরিয়ে দেখানোর চেষ্টা করি। এ কারণে তিনদিন তাদের পর্যপ্ত সময় দেওয়া সম্ভব হয় না।

নৌকার মাঝি শফিকুল ইসলাম বলেন, ছুটি দিনে দৈনিক তিন থেকে চারটি ট্রিপ হয়। এতে যা ইনকাম হয় তার অর্ধেক নৌকার মালিককে দিয়ে দিতে হয়। বাকি যা থাকে তা দিয়ে ভালো ভাবেই চলে যায়। বছরের এ সময়টাতে কোনো কাজ থাকে না। তাই পদ্মবিল এখন আমাদের মতো দরিদ্র মানুষের জন্য আশির্বাদ।

পদ্মবিল পাড়ের বাসিন্দা ও নৌকার পল্টু সরদার বলেন, বর্ষার সময় এখানে দরিদ্র ও কৃষিজীবী মানুষের কোনো কাজ থাকে না। এ সময় দর্শনার্থীদের  নৌকায় ঘুরিয়ে শতাধিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। এতে নৌকার মালিকদেরও উপার্জন হচ্ছে আবার মাঝিরাও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে থাকতে পারছেন। কিন্তু এখানে আসার রাস্তাটি সরু ও খারাপ। তাই অনেকেই গাড়ি নিয়ে আসতে পারেন না। রাস্তাটি প্রশস্ত করা হলে এখানে অনেক পর্যটক আসবে।

জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, বলাকইড় পদ্মবিল ইতোমধ্যেই ভ্রমণ পিপাসু মানুষের পছন্দের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এখানে অনেক দর্শনার্থী আসছেন। আর পদ্মা সেতুর কারণে এ বছর দর্শনার্থীর সংখ্যা তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি। মানুষ খুব সহজে এখানে চলে আসতে পারছেন। এখানে আসার সড়কের সামান্য কিছু অংশ অপ্রসস্ত হওয়ায় দর্শনার্থীদের গাড়ি নিয়ে আসতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আশাকরি খুব শীঘ্রই এ সমস্যার সমাধান করা হবে। এছাড়া মৌসুমি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্যেও আমরা কাজ করছি। তখন দর্শনার্থীদের আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

কখন আসবেন: পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা বা তার আশপাশ থেকে মানুষ এখানে দিনে এসে আবার দিনে ফিরে যেতে পারছেন। এতে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে থাকছে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। এ সময় নৌকার সংকট দেখা দেয়। তাই সরকারি ছুটির দিনে না এসে অন্যান্য দিনগুলোতে আসলে মন ভরে ঘুরে দেখা যাবে পদ্মবিলের সৌন্দর্য।

কিভাবে আসবেন: ঢাকার গাবতলী বাসস্টান্ড থেকে টেকেরহাট হয়ে গোপালগঞ্জগামী বাসে করে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলী বাসস্টান্ডে নামতে হবে। সেখান থেকে ইজিবাইকে করে করপাড়া ইউনিয়নের বলাকইড় পদ্মবিলে যাওয়া যাবে। আবার ঢাকার গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্টান্ড থেকে খুলনা বা গোপালগঞ্জগামী বাসে উঠে পদ্মসেতু পার হয়ে জেলা শহরের বেদগ্রাম বাসস্টান্ডে নামতে হবে। সেখান থেকে ইজিবাইকে করে অনায়াসে যাওয়া যাবে পদ্মবিলে। অন্যান্য জেলা থেকে এখানে আসতে হলে জেলা শহরের বেদগ্রামে নেমে ইজিবাইকে করে সহজেই পদ্মবিলে যাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০২২
এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।