ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

মন্টুর অবসর পরিচর্যা ও পুত্রশোক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৮
মন্টুর অবসর পরিচর্যা ও পুত্রশোক বাড়ির উঠনে বাঁশের বেড়া তৈরি করছেন মিন্টু । ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: সাপ্তাহিক কর্মব্যস্ততার ছুটি মাত্র একদিনের। চা বাগান অধ্যুষিত এলাকায় প্রতি রোববার সেই ছুটির গভীর রেশ। এই ছুটিই চা শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত। একটু বিনোদন, একটু আরাম-আয়েশ আর একটু ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই।

কিন্তু তাদের মধ্যও কেউ কেউ আছেন যারা হাঁটেন না আরাম-আয়েশ আর ঘোরাঘুরির পথ । মনোনিবেশ করেন অবসরের পরিচর্যাটুকুতে।

এর মাঝেই এরা খুঁজে পান আত্মতৃপ্তি আর ভালো কাজে সময় কাটানোর অনুপ্রেরণা। কিংবা আপন দুঃখ কাটানো পন্থা। তবে কোনো কোনো দুঃখবোধ, গভীর হতাশা বা মৃত্যুশোক জীবনের সচল গতিকে মন্থর করে দেয়। এর মুখোমুখি হওয়ার পর জীবনের প্রাণচাঞ্চল্য কোথায় যেন হারিয়ে যায়। বেতুয়া বাঁশের বেড়া, ছবি: বাংলানিউজদুপুরের আলো গড়িয়ে গড়িয়ে বিকেলের সময়ের দিকে ধাবিত তখন। শ্রীমঙ্গল উপজেলার জাগছড়া চা বাগানের মিশনটিলায় তখন সেই মায়াবী আলোর ঝলকানি। লালমাটির উঁচুনিচু টিলাগুলোতে লেগেছে দারুণ স্বর্ণালী স্নিগ্ধতা।

রোববার (১১ নভেম্বর) ফুলছড়া বাগানে গারো সম্প্রদায়ের উৎসব শেষে মিশনটিলায় ক্ষণিকের বিরতি। ধীর পায়ের হাঁটার ছন্দ – দখল করে নিয়েছে ভালো লাগা। পায়ের গতি যেখানে থামলো, এখানেই অতি নান্দনিকতার বুনন চলছে।

মধ্যবয়সী এই ব্যক্তির নাম মিন্টু মৃধা। লাউয়াছড়া পানপুঞ্জিতে ডে-লেবারের কাজ করেন। রোববার তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এই দিনেই তিনি বেছে নিয়েছেন তার বাড়ির সামনের বাঁশের বেড়াটি নতুনভাবে তৈরির আগ্রহে। চমৎকারভাবে তৈরি করে যাচ্ছেন বাঁশের এই বেড়া।

এটা কি ধরনের বাঁশ? –এই প্রশ্নে সহাস্যে মিন্টু মৃধা জবাব দিলেন ‘বেতুয়া বাঁশ। এটি মাঝারি আকারের বাঁশ। এটি দিয়ে সাধারণত বেড়া তৈরি করা হয়। ’

এক প্রশ্নের তিনি আরো বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। একটা কামলা (শ্রমিক) রেখে এই বাঁশের বেড়া তৈরি করতে হবে কামলার মজুরি আসবে এক হাজার থাকে পনেরশ’ টাকা। তাই খরচ বাঁচানোর জন্য নিজেই সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজের বাড়ির কাজে লেগেছি। আর এগুলো আমার নিজের বাঁশঝাড়ের বাঁশ। ’

৩০ ফুট লম্বা এবং আড়াই ফুট পাশের একটি বাঁশের বেড়ার খবর প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা জানান মিন্টু।

সংসারের কথা উঠতেই তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে। তিনি বলতে থাকেন, ‘এই বছরই আমার বড় ছেলে শ্যামল মৃধাকে মারা গেছে। গত ৩ এপ্রিল সে নিখোঁজ হয় এবং ২৬ এপ্রিল তার মৃতদেহ ঢাকা থেকে নিয়ে আসি। পরে জানতে পারি- আমাদের কাউকে না জানিয়ে সে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা গিয়েছিল। কে বা কাহারা আমরা ছেলেকে মেরে ফেলেছে। ’মিন্টুসহ তার পরিবারের সদস্যরা, ছবি: বাংলানিউজকথা বলে জানা যায়, তার স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী। তিনি ঘরের কাজ করেন। দিনমজুরের কাজ করে পুরো সংসার চালান মিন্টু। একছেলে এবং দুইমেয়ে নিয়ে তার সংসার। তবে ছেলেটি মারা গেছে। বড় মেয়ের নাম শাকিলা। সে এসএসসি পাস করে ভাইয়ের মৃত্যুশোকে এবছর আর কলেজে ভর্তি হয়নি। ছোট মেয়ে পূর্ণিমা, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে স্থানীয় কাকিয়াবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে।

মিন্টুর স্ত্রী লক্ষ্মী বলেন, যতো দিন বাঁচবো আমাদের একমাত্র ছেলেটার জন্য বুকটা হাহাকার করতে থাকবে। কষ্ট করে বড় করেছিলাম তাকে। কিন্তু এই কী বিচার বিধাতার?

মৃত ভাইয়ের প্রসঙ্গে বোন শাকিলা বলে, আমার ভাই চলতি বছর ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ফোর পয়েন্ট নাইনটি পেয়ে এসএসসি পাস করেছিল। তার কথা আমাদের সব সময় মনে হয়। তখন আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৮
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।