ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

গুপ্ত জমিদারদের স্মৃতি

গৌরবময়, ঐতিহাসিক কিন্তু বিস্মৃত

আশরাফুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১
গৌরবময়, ঐতিহাসিক কিন্তু বিস্মৃত

দেশের বহু প্রাচীন ইতিহাস ও নিদর্শন কালের বিবর্তনে লোকচক্ষুর অন্তরালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের ঐতিহাসিক কাওরাইরদী ব্রাহ্মমন্দির ও গুপ্ত জমিদারদের কাচারি বাড়ি।

এটি এ অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য হৃতগৌরবের নির্দশন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মোদের গরব/মোদের আশা- আ মরি বাংলা ভাষা’ গানের স্রষ্টা সুরকার-গীতিকার অতুল প্রসাদ সেন, ব্রাহ্মধর্ম সংস্কারক কালীনারায়ণ গুপ্ত, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম স্যার খেতাব পাওয়া কে জি গুপ্ত, পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তির স্মৃতিবিজড়িত স্থান কাওরাইদ।

কাওরাইদে এ ইতিহাসের গোড়াপত্তন করেন বিখ্যাত গুপ্ত জমিদাররা। তাঁরা সুদীর্ঘকাল এ জনপদ শাসন করেছেন অত্যন্ত সুনামের সাথে। স্থানীয় ও জাতীয় পরিমণ্ডল পেরিয়ে অনেকদূর ছড়িয়েছে এ জমিদার পরিবারের পরিচিতি ও গৌরব।

গুপ্ত পরিবারের গৌরবময় বিশাল বিস্তৃতি ও তাঁদের কৃতিত্ব অনুসন্ধানীদের বিমোহিত করে। স্থানীয় হিন্দু পুরোহিত, ব্রাহ্মমন্দির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণাপত্র অনুসন্ধানে জানা যায়, গুপ্ত জমিদারদের বর্ণাঢ্য ইতিহাস।

কাওরাইদে গুপ্ত জমিদারি এস্টেট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৯৩ সালে। নরসিংদীর ভাটপাড়ার প্রতাপশালী জমিদার মহিন্দ্র নারায়ণ গুপ্ত কাওরাইদ এলাকার তালুকগুলো কিনেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার শিলাশী গ্রামের জমিদার মীর আহম্মদের কাছ থেকে। ভাটপাড়ার বিশাল এলাকাসহ শ্রীপুরের কাওরাইদ এলাকা ও ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলে গুপ্ত পরিবারের জমিদারি বিস্তৃত ছিল।

এ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার শ্রী মহিন্দ্র নারায়ণ গুপ্ত সন্তানহীন হওয়ায় তাঁর বিশাল আধিপত্য রক্ষার জন্য দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার (পুরাতন রায়পুরা) চুলা ইউনিয়নের আকানগর গ্রামের সুধারাম সেন ও যশোধা দেবীর পুত্র কালীনারায়ণ সেনকে। জমিদারবাবু কালীনারায়ণকে পুত্রস্নেহে পালন করতে থাকেন। ফলে তিনি সেন থেকে গুপ্ত উপাধিপ্রাপ্ত হন। কালীনারায়ণ তেমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি, তবে নিজ প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞাবলে বাংলা, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তাছাড়া হিন্দুধর্মীয় ভক্তিগীতি গেয়ে সে সময়ে তিনি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ১৮৬৯ সালে তিনি হিন্দু ধর্মসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ প্রবর্তিত ব্রা‍হ্মধর্মে দিক্ষিত হন। সে সময়ে এ ধর্ম সংস্কার আন্দোলনকে পূর্ববাংলায় বেগবান করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেন কালীনারায়ণ।

জমিদার কালীনারায়ণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ইংরেজ শাসনামল থেকেই দেশ ও বিদেশে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। কালীনারায়ণের বড় ছেলে কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত ওরফে কে জি গুপ্ত বিপুল খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তাকে কিংবদন্তি বাঙালি মনে করা হতো।

কে জি গুপ্ত ১৮৫১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ভাটপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রখর মেধাবী কে জি গুপ্ত শিক্ষাজীবন শুরু করেন ঢাকার পগোজ, পরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। কলেজজীবনে অত্যন্ত ভালো ফলাফল করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন অক্সফোর্ডে কে জি গুপ্তকে সবচে মেধাবী ভারতীয় বলে গণ্য করা হতো। সে সময় কেবল ইংরেজ বংশোদ্ভূতরাই উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি পেত। কিন্তু কে জি গুপ্ত নিজ প্রতিভাবলে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙ্গে আইসিএস অফিসার হিসেবে চাকরি অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়ের ভারতীয় কাউন্সেলরের প্রথম ভারতীয় সদস্য, ইংল্যান্ডের হাউস অব কমনসের সম্মানিত সদস্য ছিলেন। এছাড়া ইংল্যান্ডের রানি কর্তৃক দুর্লভ সম্মানসূচক ‘নাইট কমন্ডারস অব দি স্টার’ এবং ব্রিটিশ প্রশাসন প্রথম ভারতীয় হিসেবে তাকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে।

স্যার কে জি গুপ্ত ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বিলেতের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে ইংরেজদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আন্দোলনরত বাঙালি সৈনিকদের আইনি সহায়তা দেন তিনি। প্রসন্ন তারা গুপ্তা ওরফে তুফানী গুপ্তা হচ্ছেন স্যার কে জি গুপ্তের সহধর্মিণী। তুফানী গুপ্তা ১৮৮৬ সালে কলকাতায় সখী সমিতি নামে নারী উন্নয়ন কেন্দ্রিক একটি সামাজিক সংগঠনের গোড়াপত্তন করেন। এ সংগঠনটি ওই সময়ে স্ত্রীশিক্ষা, বিধবা বিয়ের প্রচলন, সহমরণ প্রথা রোধসহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারে  অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। লাকসামের জমিদার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এ সংগঠনের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

স্যার কে জি গুপ্ত ও তুফানী গুপ্তা দম্পতির চার সন্তান ছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন বীরেন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত, ধীরেন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত, যতীন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত ও হেম কুসুম গুপ্তা। মেয়ে হেমকুসুম গুপ্তার বিয়ে হয় কে জি গুপ্তের ভাগনে উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ, সুরকার, গীতিকার ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেনের সাথে। পবিত্র কুরআনের প্রথম সার্থক বাংলা অনুবাদক মৌলভী ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন স্যার কে জি গুপ্তের মামা।

কে জি গুপ্তের ভাইবোনের মধ্যে অনেকেই শৈশবে মারা যান। জীবিতদের মধ্যে অন্যরাও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এর মধ্যে প্যারী মোহন গুপ্ত ভারতের তৎকালীন খ্যাতিমান সিভিল মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তৃতীয় ভাই গঙ্গাগোবিন্দ গুপ্ত বিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন ঢাকার হোলিখেলা উৎসবের উদ্যোক্তা। কে জি গুপ্তের বোন হেমন্ত শশী গুপ্তা অতুলপ্রসাদের মা। দ্বিতীয় বোন চপলা গুপ্তার বিয়ে হয়েছিল শশীভূষণ গুপ্তের সাথে। তৃতীয় বোন সৌদামিনী গুপ্তা। তাঁর ছেলে চারুচন্দ্র আর চারুচন্দ্রের মেয়ে বিজয়া হচ্ছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী। চতুর্থ বোন সরলা গুপ্তা। তাঁর মেয়ে সুপ্রভা হলেন সুকমার রায়ের স্ত্রী সত্যাজিৎ রায়ের মা।

এ পরিবারের সদস্যরা আজও দেশে-বিদেশে সুনামের সাথে কর্মক্ষেত্রে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৩ ও ২০০২ সালে কালীনারায়ণ গুপ্তের তৃতীয় অধঃস্তন পুরুষ সুজিত গুপ্ত বিখ্যাত টাটা গ্রুপের আবাসিক পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি অফিসের কাজে ঢাকায় এসে তাঁর পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত কাওরাইদ জমিদার বাড়ি বেড়িয়ে গেছেন।

সে সময়ে তিনি তাঁর বংশধরদের সাম্প্রতিক পরিচয় প্রদান করেন বর্তমান ব্রাহ্মমন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবুজ কুমার দীপক পালের সাথে। তার বর্ণনামতে, সুজিত গুপ্তের স্ত্রী শীলা গুপ্তা টাটা আয়রন ওয়ার্কস’র নয়াদিল্লিস্থ আবাসিক পরিচালক হিসেবে কর্মরত। বংশধরদের মধ্যে যারা জীবিত সবাই গর্ববোধ করেন তাঁদের গৌরবময় বিস্তৃতির জন্য। আর তাদের বংশধর এবং আত্মীয়স্বজনরা সবাই দেশে ও বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত।

সুজিত গুপ্ত কাওরাইদ এসে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, তিনি পরে যখন ঢাকায় আসবেন তখন অবশ্যই তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি অবলোকন করতে ভুলবেন না। তাদের পুর্ব-পুরুষের আদি নিবাস নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামেও যাবেন।

কাওরাইদে গুপ্ত জমিদার পরিবারের স্মৃতি আকঁড়ে ধরে স্থাপিত হয়েছে কাওরাইদ কে এন উচ্চ বিদ্যালয়। গুপ্ত পরিবারের বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে মন্দির চত্বরে রয়েছে সতেরটি স্মৃতি ফলক। স্মৃতিফলকে যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন স্যার কেজি গুপ্ত, প্রসন্ন তারা গুপ্তা, কালীনারায়ণ গুপ্ত, অন্নদা সুন্দরী গুপ্তা, প্যারী মোহন গুপ্তা, গঙ্গাগোবিন্দ গুপ্তা, বিনয় চন্দ্র গুপ্ত, হেমন্ত শশীগুপ্ত, সরলা সুন্দরী দেবী, বিমলা দাস, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, শশীভূষণ দত্ত, সরযুবালা সেন, মিহির কুমার সেন, হিমাংশু মোহন গুপ্ত, অতুল প্রসাদ সেন ও বিনোদ মণি গুপ্তা। স্মৃতিফলকগুলো মূল্যবান শ্বেতপাথরে নির্মিত।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্মৃতিফলক চত্বরে অতুল প্রসাদ সেনের স্মৃতিফলকে ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’ লেখা থাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে স্মৃতিস্তম্ভের কিছু অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু পুনর্নির্মাণ করা হয়।

গুপ্ত জমিদার আমলে কাওরাইদ রেলওয়ে স্টেশন থেকে বাঁধানো একটি রাস্তা জমিদার বাড়ি পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। রাস্তার দু ধারে ছিল বাহারি ফুল, দেবদারু, বিটল পাম্পসহ বিরল প্রজাতির দেশী-বিদেশী গাছ।

ইতিহাসবিদদের মতে, গুপ্ত জমিদারি আমলে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উঠেছিলেন গুপ্ত জমিদারদের কাওরাইদের বাংলোতে। অল্প সময় অবস্থান করে তিনি আবার রওনা হন ময়মনসিংহের পথে-- এমন তথ্য জানান ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. ফরিদ আহম্মদ। এই বাংলোর নয়নাভিরাম প্রাঙ্গণে বসেই সংগীতজ্ঞ অতুল প্রসাদ রচনা করেছিলেন বহু বিখ্যাত গান।

তথ্যমতে, বিশ্ববিখ্যাত বহু গুণীজনের পদধূলি পড়েছে কাওরাইদ ব্রাহ্মমন্দির অঙ্গনে। কাচারি বাড়ির প্রাঙ্গণে অসংখ্য ফুলের গাছের সমাহারে সুশোভিত ছিল, যা আজ কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে গেছে। সুতিয়া নদীর সুনির্মল প্রবাহ ঘেঁষে এক সময়ের প্রমোদ উদ্যান মুখর ছিল বহু বরেণ্য ব্যক্তির পদচারণায়। কিন্তু আজ সবই বিস্মৃত গৌরব।

দেশের যে কোনো জায়গা থেকে অনুসন্ধানী গবেষক ও ভ্রমণপিয়াসীরা অনায়াসে আসতে পারেন কাওরাইদের গুপ্ত জমিদারদের কাচারি বাড়িতে। সড়কপথে ঢাকা থেকে জৈনাবাজার হয়ে বাসে বা যে কোনো যানবাহনে কাওরাইদে আসা যায়। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক হয়ে জৈনা বাজারের দূরত্ব ৫৯ কিলোমিটার। রেলপথে কমলাপুর থেকে কাওরাইদ স্টেশন নেমে পায়ে হেঁটে পর্যটকরা আসতে পারেন এ ঐতিহাসিক স্থানে । রেলপথে ঢাকার-কমলাপুর থেকে কাওরাইদের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।