ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

দলিত মানুষের ত্রাণকর্তা

ইরানী বিশ্বাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২০ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১১
দলিত মানুষের ত্রাণকর্তা

গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার একটি ইউনিয়ন ওড়াকান্দি। প্রায় দুশো বছর আগে ১২১৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে (১৮৪৬ সালের ১৩ মার্চ)  ওড়াকান্দির পার্শ্ববর্তী সাফলিডাঙ্গা গ্রামে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন।

পিতা যশোবন্ত ঠাকুর ও মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। যশোবন্ত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ছিলেন। বৈষ্ণবভক্ত হিসেবেও এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মেছিলেন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। জন্মের সময় তাঁর শরীরে বত্রিশ রকমের লক্ষণ ছিল, যা হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী অবতার পুরুষের বিশেষ লক্ষণ। এই লক্ষণগুলি গৌতম বুদ্ধের শরীরেও ছিল।

অনেকেই মনে করেন হরিচাঁদ ঠাকুর আসলে বুদ্ধদেব ও শ্রী চৈতন্যদেবের যুগপৎ অবতার। অল্পদিনের মধ্যেই এই বিশেষ লক্ষণ হরিচাঁদ ঠাকুরকে অবতারপুরুষ হিসেবে প্রচারের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। হরিচাঁদ ঠাকুর অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে বংশানুক্রমিকভাবে বৈষ্ণবীয় যে পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েছেন তাতে তিনি ক্রমান্বয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর পিতা ও পিতার সতীর্থদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বৈষ্ণবীয় পরিবেশে অবস্থান করার সুযোগে বিভিন্ন শাস্ত্রালোচনায় অংশগ্রহণ এবং প্রাসঙ্গিক শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। একই প্রক্রিয়ায় তিনি দেশীয় চিকিৎসা ও ভূমিব্যবস্থাসহ নানা ধরনের ঐতিহ্যিক জ্ঞানে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন।  

প্রথম জীবনে হরিচাঁদ ঠাকুর মাঠে গরু চরাতেন। বয়সের সাথে সাথে তিনি কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। তবে অবতারপুরুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে তিনি সক্রিয় হন ভক্তদের মনরক্ষার কাজে। এ সময় সাফলিডাঙ্গা ছেড়ে ওড়াকান্দিতে বসবাস শুরু করেন।   অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি ভক্তদের রোগ থেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন কল্যাণসাধন করতেন। ধীরে ধীরে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে। হরিভক্তদের মতুয়া বলা হয়। মতুয়াদের ভক্তি ও হরিচাঁদ ঠাকুরের শক্তি এ দুয়ে মিলে ওড়াকান্দি ক্রমান্বয়ে দেশে দেশে পরিচিত হয়ে ওঠে।

বর্তমানে ওড়াকান্দি একটি তীর্থধামে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ভক্তদের ধারণা, হরিচাঁদ ঠাকুর মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জন্মতিথিতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় ওড়াকান্দিতে।

হরিচাঁদের ধর্মদর্শন ছিল সমন্বয়বাদী। তবে সমকালে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীতে বৈষ্ণব আদর্শের যে ধারা প্রচলিত ছিলো সেটাই সর্বাধিক জায়গা দখল করে আছে এখনো। পতিতজনের মুক্তির পন্থা দান করাকে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অবতার গ্রহণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে বলা যায় নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির বিষয়টি তাঁকে বিশেষভাবে প্ররোচিত করেছিলো। প্রচলিত ধর্মশাসন পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব এবং আন্তরিকতাহীন অভিহিত করে হরিচাঁদ ঠাকুর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সংসারের কর্মযজ্ঞের মধ্য থেকেই ধর্মকর্ম করা সম্ভব। যে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চা বাহুল্যমাত্র। ভক্তদের প্রতি তাঁর প্রধান উপদেশ ছিল, ‘হাতে নাম মুখে কাজ’।

বিবিধের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে পারার যে মহৎ গুণ বাঙালির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য, মতুয়া আদর্শের মধ্যে তা লক্ষণীয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মনীষী মাত্র ৬৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। দলিত মানুষের জন্য অনেক কাজ করার বাসনায় মৃত্যুর পূর্বে হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুরকে। তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ভক্তরাও গুরুচাঁদ ঠাকুরকে হরিচাঁদের স্থলাভিষিক্ত করে তাঁর উপাধি দেন ‘হরিগুরুচাঁদ’।

ভারতীয় সমাজব্যবস্থার মতই ভারত ইতিহাসেরও আছে দুটি স্বতন্ত্র স্তর। একটি উঁচুতলার, অন্যটি নীচুতলার। নীচুতলার ইতিহাস আজো অন্ধকারে নিমজ্জিত। উঁচুতলার মানুষ ঘৃণায়-অবহেলায় সে ইতিহাসকে গুরুত্ব দেবার তেমন প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু ভারতীয় সমাজবদলের ক্ষেত্রে এ ইতিহাসের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। আর গুরুচাঁদ শুধু পিছিয়েপড়া হিন্দু জাতির জন্য কাজ করেননি। তিনি মূলত মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখতেন। তার কাছে কোনো জাতিভেদ ছিল না। তাই তাঁর পরমপ্রিয় ভক্ত হয়েছিলেন খুলনার  তিনকড়ি মিঞা। তার নাতি জালালউদ্দিন বর্তমানে মতুয়া দলপতি। বিদেশি দম্পতি ডা. এস এস মিড তাকে ডেকেছিলেন ধর্মপিতা।

ধর্মযোগী হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়াধর্মের মাধ্যমে অবহেলিতদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন। তখনকার দিনে শিক্ষাবিস্তারের সুযোগ ছিল কম। তবু তাঁর এ ব্যপারে তীক্ষè দৃষ্টি ছিল এবং নিজ পুত্র গুরুচাঁদকে শিক্ষার প্রসারে প্রয়াস নিতে নির্দেশ দিয়ে যান। গুরুচাঁদও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেন। তাঁর কাছে যিনিই আসতেন তাকে বলতেন, সন্তান যেন অশিক্ষিত না থাকে। সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারলেই আমাকে সন্তুষ্ট করা যাবে।

এ আন্দোলন তিনি শুধু নিজ সম্প্রদায় নমঃশূদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তেলি, মালি, কুম্ভকার, কাপালি, মাহিষ্য সব সম্প্রদায়ের জন্যই কাজ করে গেছেন। কোথাও স্কুল স্থাপিত হলে তার দ্বার ছিল সবার জন্য খোলা। উচ্চবর্ণ যখন সমাজ-অধিপতি ঠিক সে সময়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর দলিত মানুষের শিক্ষা ও ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। দলিত নমঃশূদ্র জাতি শিক্ষালাভ করবে এটা মোটেই সমুচিত ছিল না সে সময়ে। তবু গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন তার লক্ষ্যে অটল। যাবতীয় বাধাবিঘœ কাটিয়ে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ওড়াকান্দিতে তিনি প্রথম স্কুল স্থাপন করেন। এটা কোনো রাজা-মহারাজার কাজ নয়। দলিত সমাজের সাধারণ একজন মানুষ নিজের জাতির কথা চিন্তা করে নিজের উদ্যোগে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ স্কুলেই প্রথম তিনি ছাত্রবৃত্তি চালু করেন। পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পরে এটি মিডল ইংলিশ স্কুলে পরিণত হয়। তিনি বুঝেছিলেন, বর্ণহিন্দুর শিক্ষার ব্যাপারে কোনোরূপ সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাই তিনি খ্রিস্টান মিশনারি ড. মিডের সহায়তা নেন এবং সরকারি সাহায্যে ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দির মিডল ইংলিশ স্কুলকে হাই ইংলিশ স্কুলে পরিণত করেন।

১৮৮১ সালে খুলনার দত্তডাঙ্গায় এক নমঃশূদ্র মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঈশ্বর গায়েনের বাড়িতে। সেখানে দলিত সমাজে শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা ও উপায় সম্বন্ধে তিনি শতাব্দীর সেরা ভাষণ দেন। এর পর থেকেই তিনি একের পর এক স্কুল স্থাপন করতে থাকেন। তার দেখাদেখি চারিদিকে স্কুল খোলার ধুম পড়ে যায়। এসব নতুন স্কুলে শিক্ষাদান করতেন হাই ইংলিশ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। এই ভাবে দুর্গম অনুন্নত সুন্দরবন অঞ্চলেও শিক্ষা বিস্তার সম্ভব হয়।

দলিত জাতির শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেমন আন্দোলন করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর, তেমনি চাকরিক্ষেত্রেও তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তার ফলে বিশ শতকের প্রথম দশকেই অর্থাৎ ১৯০৯ সালে শিক্ষা, চাকরি ও পরবর্তীকালে আইনসভায় আসন সংরক্ষিত হয়েছিল। এমনকি তারা তফশিলভুক্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।

গুরুচাঁদ নিজের পুত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম পুত্র শশীভূষণ লক্ষ্মীপাশা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। তিনি প্রথম ‘নমঃশূদ্র সুহৃদ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। শিক্ষা আন্দোলনের সাথে সাথে কর্মক্ষেত্র লাভের আন্দোলনও শুরু করেছিলেন। তৎকালে গুরুচঁদের নেতৃত্বে পাঁচ সহচারীকে নিয়ে তিনি ছোটলাটের কাছে দেখা করেন। সেখানে তাঁরা জানান, সামাজিক অবিচারের জন্য নমঃশূদ্রদের শিক্ষা প্রসারে ব্যহত হচ্ছে। তাই সরকারি পরিষেবায় নিয়োগের বিশেষ প্রয়োজন। এর পরে শশীভূষণ নিযুক্ত হন সাব-রেজিস্ট্রার, ডা. তারিণী চরণ বালা সরকারি ডাক্তার এবং কুমুদ বিহারী মল্লিক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। এটাই ছিল প্রথম কোনো নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সরকারি কাজে যোগদান।

১৯৩২ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর ‘শ্রীশ্রীহরি-গুরু মিশন’ স্থাপন করেন। এই মিশনের মাধ্যমে তিনি গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট, পাঠশালা, স্কুল ও ছাত্রাবাস স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এই মিশনের উদ্যোগে তিনি তালতলাতে ‘শান্তি-সত্যভামা বালিকা বিদ্যালয়’ নামে মেয়েদের একটি আলাদা স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া মিসেস মিডের সহযোগিতায় ১৯০৮ সালেই মেয়েদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। প্রসূতি মা ও শিশুসেবার জন্য নির্মিত হয় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, যা আজও ওড়াকান্দিতে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। দলিত মানুষের আধুনিক চিকিৎসাসেবার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের খরচে তারিণী বালাকে এমবিবিএস পড়িয়েছিলেন। আপন পৌত্র মন্মথ ঠাকুরকেও এমবিবিএস পড়ান। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে পায়খানা তৈরি ও পানীয় জলের পুকুরকে আলাদা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই মনীষী যে আধুনিক চিন্তা করেছিলেন, আজও তা অব্যাহত রয়েছে মানবসমাজে।
 
১৯১৯ সালেই নতুন ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয় এবং তাতে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকার মেনে নেওয়া হয়। এরই ফলে বাংলার বিধান পরিষদে সর্বপ্রথম প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান গুরুচাদের অনুসারী ভীষ্মদেব দাস। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে ১৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজন ছিলেন অস্পৃশ্য সমাজের। এরা ছিলেন ভীষ্মদেব দাস ও নিরোদবিহারী মল্লিক। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও বিধান পরিষদে মনোনীত হতে পেরেছিলেন শুধু গুরুচাঁদ ঠাকুরের কারণে।

শুধু শিক্ষাবিস্তারেই এই মনীষী থেমে থাকেননি, সমাজ উন্নয়নেও অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এমন অনেক কাজ করেছিলেন যা এই যুগের নিরিখে অতি ত্চ্ছু মনে হলেও সেই সময়ে ছিল বিস্ময়কর সমাজকল্যাণমূলক কাজ। ‘নমঃশূদ্র কল্যাণ সমিতি’ গুরুচাঁদ ঠাকুরের এমনই একটি মহৎ কাজ। কয়েকটি গ্রাম বা কয়েকটি ‘মিলা’র সৎ কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হতো এই সমিতি। এর উদ্যেশ্য ছিল বহুমুখী। শিক্ষাবিস্তার, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মজাপুকুর খনন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, সৎ উপায়ে জীবনধারণ করা, মানুষকে সাহায্য করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।

অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শাক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে গুরুচাঁদ ‘লক্ষ্মীর গোলা’ গঠন করেছিলেন। মরসুমের সময়ে ধান সংগ্রহ করে এ গোলায় রাখা হতো। দাম বাড়লে বিক্রি করে বিভিন্ন সামাজিক উপকরণ কেনা হতো। কখনো কখনো দুর্ভিক্ষের সময় এই ধান গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হতো। আবার কখনো কখনো গোলার ধান ধারে দেওয়া হতো। তবে ফেরত দেয়ার সময় এক মণ ধানে ১০ সের বেশি দিতে হতো। এটা আসলে গ্রামীণ ব্যাংকিং পদ্ধতি ছিল। গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন বিচক্ষণ। তার চিন্তাচেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি স্বনির্ভরতা অর্জনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থ ছাড়া মুক্তি নেই। তিনি সবসময় বলতেন, অর্থ হলো চঞ্চলার ধন, যতœ না করলে ধরে রাখা যায় না। অর্থ ছাড়া অর্থ আসে না। তাই সমবায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহাজনি কারবার করে ধনসম্পদ তথা মূলধন বৃদ্ধির উপদেশ দিতেন ভক্তদের। বাণিজ্যতরী নির্মাণ করে সেই নৌকায় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করার পদ্ধতিকে তিনি মহাজনি কারবার বলতেন।

১৮৫৮ সালে কৃষক বিদ্র্রোহ এবং ১৮৫৯-৬০ সালে নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের মধ্যে নীল বিদ্রোহ হয়। এ সময় শক্তিশালী জমিদাররা কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮৭২-১৮৭৬ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও তাদের অনুচরদের সংঘবদ্ধ কৃষকেরা আক্রমণ করে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর।

গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন মূলত দলিত পিছিয়ে পড়া সমাজের পথিকৃৎ। তিনি এই পিছিয়ে পড়া সমাজকে শিক্ষার আলো জ্বেলে অগ্রগামী করেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি শুধু গোপালগঞ্জ নয়, ভারতবর্ষেও বহু পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন। এসব দলিত মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছেন।

কিন্তু ২০০ বছর পরে এসে আমরা দেখছি গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। এখনো নিম্নবর্ণের জেলা হিসেবে কাশিয়ানীতে উন্নতির ছোঁয়া পড়েনি। তারা এখনো নৌকায় চড়ে স্কুলে যায় শিক্ষালাভের জন্য। নেই পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, যানবাহন, পানীয় জলের সুব্যবস্থা। এমনকি অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। আমাদের মাঝে আরো একজন গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্ম নেওয়া খুব জরুরি, যিনি ভাগ্যবঞ্চিত এসব মানুষকে উদ্ধার করবেন ।

খ্রিস্টান ধর্মযাজক ডা. সি এস মিড গুরুচাঁদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, সারা ভারতবর্ষের প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের মধ্যে তার মতো একজন দূরদৃষ্টি ও তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন এবং অমিত তেজস্বী মানুষ দেখেননি তিনি। ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে একজন মহামানব হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বলেছিলেন মহান গুরু।

প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে তিনি দিন বরুনীমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের ঠাকুরনগর ও ওড়াকান্দিতে এ উপলক্ষে লাল নিশান উড়িয়ে, জয়ডাঙ্কা বাজিয়ে, সিঙ্গা ফুঁ দিয়ে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ ভক্তরা যোগ দেয়। গুরুচাঁদ ঠাকুর মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।