ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

এক ‘গাছদাদা’র গল্প

জুলফিকার আলী কানন, মেহেরপুর থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৩ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১১
এক ‘গাছদাদা’র গল্প

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আজিজুল হক সারাটি জীবন গাছ লাগিয়ে গেছেন। শুধু নিজের জমিতেই নয়, তিনি গাছ লাগিয়েছেন প্রতিবেশীর জমিতে, সরকারি জমিতে, গ্রামের নানা মানুষের বাড়িঘরের জমিতে।

এজন্য তার নাম হয়েছে ‘গাছদাদা’।

রাস্তার দু পাশ, গ্রামের দিগদিগন্তজুড়ে যে দিকেই চোখ যায় ঘন গাছগাছালিতে ভরা। যেন সবুজের সমাহার। মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহারবাটি ইউনিয়নের মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের পাশে গাংনীর প্রবেশমুখেই এই বাঁশবাড়িয়া গ্রাম। আর সবুজে ভরা এমন একটি গ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা যে একজনমাত্র ব্যক্তি, তা অবিশ্বাস হওয়ার মতই ঘটনা। কিন্তু যখন গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সম্বস্বরে বলেন, ওই দেখেন প্রধান রাস্তার দু পাশের বড় বড় কাঁঠাল, আম ও পাকুঁড়ের গাছ সবই ঐ দাদার লাগানো। আবার গ্রামের চারিদিকে যত বড় বড় গাছ দেখছেন তার ৬০ ভাগ গাছও উনার হাতে লাগানো। এই গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই, যে বাড়িতে তার লাগানো গাছ নেই। তখন একজন ব্যক্তির এমন অবিশ্বাস্য কা-কে বিশ্বাস করতেই হয়।

বাঁশবাড়িয়া সড়কের পাশেই বাড়ি শিক্ষক আজিজুল হকের। ১৯৬১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি পথেপ্রান্তরে যেখানেই ফাঁকা জায়গা দেখেছেন, সেখানেই নিজের পয়সায় চারা কিনে গাছ লাগিয়ে বেড়িয়েছেন। শুধু তাই নয়, কখনো নিজে, কখনো শ্রমিক নিয়ে লাগানো গাছের পরিচর্যা করতে নিজেই সাইকেল চালিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন চতুর্দিক। গরু-ছাগলে যেন গাছ নষ্ট না করতে পারে সেজন্য নিজের ঝাঁড়ের বাঁশ কেটে নিজেই ঝাঁপড়ি বানিয়ে তা লাগিয়ে পানি পর্যন্ত দিয়ে এসেছেন। এখন তার বয়স ৭৫। দীর্ঘ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আজিজুলের শরীর বয়সের ভারে ও রোগে নুয়ে পড়লেও এখনও হাতে নিড়ানি, কোদাল নিয়ে সাইকেলে চড়ে গাছ পরিচর্যা করে বেড়ান। গ্রামের সকলের কাছে এই আজিজুল হক মাস্টার এখন ‘গাছদাদা’ বলে পরিচিত।

অনেক খোঁজাখুঁজি করে প্রধান সড়কের পাশে তারই লাগানো একটি বিশাল পাকুঁড় গাছের নিচে বাঁশের মাচায় বসে বিশ্রাম নেওয়া অবস্থায় পাওয়া গেল আজিজুল হককে। এই অসাধারণ কর্মকা- সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বললেন, ছোটবেলা বইয়ে পড়তাম গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। গাছের পাতা ফুল ফল মানুষ পশু-পাখির পুষ্টিকর খাদ্য ও ওষুধ। গাছ রোদ-বৃষ্টিতে মানুষের মাথার ছাতা হয়ে কাজ করে। এই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও পুষ্টিকর ফল দিতে তিনি নিঃশর্তভাবে বৃক্ষপ্রেমিক হয়ে পড়েন বলে জানালেন। ১৯৬০ সালে এসএসসি পাসের আগে নিজের বাড়িতে গাছ লাগানো শুরু করেন। ’৬১ সালে মেট্রিক পাস করে বাঁশবাড়িয়া প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলে সেখানে ফলজ ও ঔষধি গাছ লাগিয়ে ভরিয়ে তোলেন স্কুলের চর্তুপাশ। ওই বছরের ১৫ মার্চ জনকল্যাণার্থে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের সরকারি জায়গায় একটি পাঁকুড় গাছ লাগিয়ে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। এখন এই পাঁকুড় গাছটি রাস্তার বিশাল অংশজুড়ে ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর কিছু দূরে সারিবদ্ধভাবে লাগানো আরও কয়েকটি বিশাল আকৃতির পাঁকুড় গাছ দেখা গেল। তিনি জানান, ওই গাছগুলি ’৬৫ সালের ১৩ জুলাই লাগানো। এভাবে শুধু গ্রামেই নয়, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের পোড়াপাড়া, বাঁশবাড়িয়া, গাংনীর প্রায় ৫ কিলোমিটার পথের দু পাশে ১০ ফুট পর পর ফলজ, বনজ, ঔষুধি গাছ লাগিয়েছেন তিনি। এছাড়া বাঁশবাড়িয়া-সাহারবাটি ও বাঁশবাড়িয়া-চিৎলা সড়কের দুই পাশে শত শত গাছ লাগিয়েছেন। এভাবে গাংনী উপজেলার প্রায় ২০-২১ কি.মি. পথজুড়ে তার লাগানো গাছই এখন সড়কগুলিকে ছায়ায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে।

তিনি বললেন, রোদ-বৃষ্টির সময় যখন গাছের নিচে গিয়ে কেউ একটু স্বস্তি নেয় কিংবা রাস্তার পাশে তার লাগানো গাছের ফল যখন গ্রামের অভাবী ছেলেদের মৌসুমি ফল খাওয়ার সুযোগ করে দেয় তখন তার খুব ভালো লাগে। আর এ কারণেই এই কাজে তিনি কতসংখ্যক গাছ লাগিয়েছেন আর এতে খরচই বা কত হয়েছে তার হিসাব করেননি তিনি। এ সময় জড়ো হওয়া লোকজন জানালেন, তার লাগানো গাছের বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। আর গাছের সংখ্যা হাজার হাজার।

’৬১ সালে ১ টাকা পারিশ্রমিকে মুনিষ (শ্রমিক) নিয়ে গাছ লাগিয়ে ও পরিচর্যা করে বেড়াতেন তিনি। এখন সেই মুনিষের হাজিরা ২০০ টাকা দিতে হয়। ’৬১ সালে প্রতিটা ৬ ফুট লম্বা আম ও কাঁঠালের চারা ৫ টাকা মূল্যে কিনে লাগিয়েছেন। এখন সেই চারার দাম এক থেকে দেড়শ টাকা। তার শিক্ষকতার প্রথম বেতন ছিল ৩৫ টাকা। আইয়ুব আমলে ১০ টাকা বাড়ে। বাঁশবাড়িয়া, ধানখোলা, চিৎলা, বাগুন্দা হয়ে আবার চিৎলা ও বাঁশবাড়িয়া প্রাথমিক স্কুলে দীর্ঘ শিক্ষকতা করে তিনি ’৯৭ সালে অবসর নেন। বেতনের বেশির ভাগ অর্থ, নিজের ঝাড়ের বাঁশ, সকাল-সন্ধ্যা অমানুষিক শ্রম সবকিছু দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন এই ছায়াঘেরা গ্রাম ও বিভিন্ন রাস্তা। যে স্কুলেই শিক্ষকতা করেছেন, সেই স্কুলেই নিজ উদ্যোগে গাছ লাগিয়েছেন। তিনি শুধু গাছ লাগিয়েই সফল হননি, একজন পিতা হিসেবেও সফল। তাঁর ৩ মেয়ের মধ্যে নার্গিস আক্তার বানু ও শাহানাজ পারভীন দুজনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেছেন। অপর মেয়ে সায়েদা খাতুন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে আর পড়েননি। সবাই গৃহবধূ। ৫ ছেলের মধ্যে ড. আসাদুজ্জামান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রফেসর, ইসতিয়াক আহমেদ মেহেরপুর সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক, মোস্তাক আহমেদ গাংনী বিএন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক, ডা. নাহিদুজ্জামান দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশের পর এখন সেখানেই এফসিপিএস ডিগ্রি করছেন এবং সাইদুজ্জামান মেহেরপুর সরকারি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক পাস করে গর্বিত পিতার পাশে থেকে কাজ করছেন।

শিক্ষক আজিজুল হক সম্পর্কে জানতে চাইলে গ্রামবাসীর সবারই উত্তর, রাস্তার দু পাশে এবং গ্রামজুড়ে যত গাছ দেখছেন প্রায় সবই ঐ ‘গাছদাদা’র লাগানো। গ্রামের আব্দুল আওয়াল (৪৮) বলেন, তার বাড়ির ২৫টা আম-কাঁঠালের গাছ ওই দাদার লাগানো। এভাবে গ্রামের মন্টু বলেন তার বাড়ির ২৮টা, আনোয়ার হোসেন বলেন, তার বাড়ির ১৫টা, আবু হাশেম বলেন, তার বাড়ির নারকেল বাগান, কলিমুদ্দিন শেখ ও খোরশেদ আলী বলেন, তার বাড়িসহ গ্রামের সব বাড়িতেই তার লাগানো একাধিক ফলজ গাছ আছে।

বাঁশবাড়িয়া মাধ্যমিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সুজন ও শিমুল হোসেন, কুষ্টিয়া ইসলামি কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পাস করা এ গ্রামের ছেলে আরিফুল ইসলামসহ এই প্রজন্মের একাধিক কিশোর ও যুবক জানালো, তারাও ওই ‘গাছদাদা’র গাছ লাগিয়ে বেড়ানো দেখেছেন। এবং তার উৎসাহে এখন গ্রামের সবাই বেশি বেশি গাছ লাগাচ্ছেন বলে জানালেন তারা।

গাংনী উপজেলার সাহারবাটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু বাংলানিউজকে  জানান, তার ইউনিয়নের অনেক সড়কের গাছই আজিজুলের লাগানো। এ কারণে অনেক প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা থেকে গ্রামের ঘরবাড়ি, ফসল রক্ষা পায়। গাংনী উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম আজিজুলের মহান কীর্তিকে শুধু মেহেরপুর জেলার মধ্যেই নয়, বাংলাদেশের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক বলে দাবি করে বাংলানিউজকে বলেন, বৃক্ষপ্রেমী আজিজুলের লাগানো গাছের দাম কয়েক কোটি টাকা, কিন্তু সেই গাছের মালিক অন্যজন। তিনি অন্যকে বৃক্ষসম্পদের মালিক করিয়ে নিজে তৃপ্ত হতেই পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ রোপনের মতো কাজটি করে বেড়িয়েছেন।

মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের যেসব জায়গায় তার লাগানো গাছ আছে, এক সময় সে জায়গার মালিক ছিল মেহেরপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তারা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেসব গাছের ফলভোগ ক্ষমতা আজিজুল হককে দিয়েছিলেন। তিনি সেই ফল নিজে গ্রামের অভাবি মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করতেন। ২০০৩ সালের ১৮ আগস্ট (স্মারক নম্বও ৫২০) মেহেরপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কাজী আব্দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয়েছিল, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ২৪ কি.মি. পথের দু পাশের শত শত ফলজ গাছ আজিজুলের লাগানো হওয়ায় সওজের বিভাগীয় সিদ্ধান্তমতো ওই গাছের ফলভোগের ক্ষমতা আজিজুল হককে দেওয়া হলো। এতে খুশি হয়ে তার সাথে গ্রামবাসীও তখন গাছের পরিচর্চা করতেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মেহেরপুর জেলা পরিষদ রাস্তার পাশের জায়গা ও গাছ তাদেও বলে দাবি করে। তখন থেকে শুধু আজিজুলই নন, গ্রামের লোকজনও ওই গাছের ফলভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের অভিযোগ, এখন জেলা পরিষদের কিছু অসাধু লোক সেই ফল চুির করে বিক্রি করে দেয়। ফলে পরিচর্চার অভাবে এখন গাছগুলি মরে যেতে বসেছে। আজিজুলের ছেলে প্রভাষক মোস্তাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ছোট থেকেই দেখে আসছি বাপের গাছ লাগানো। তখন আমরা তার ওপর খুব বিরক্ত হতাম। রাগ করতাম। কিন্তু এখন বাবাকে নিয়ে গ্রামের সবাই যখন গর্ব করে, তখন নিজেদের কর্মকে খুবই তুচ্ছ মনে হয়।

মেহেরপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের বর্তমান উপ-সহকারী প্রকৌশলী শওকত আহমেদ মজুমদার আজিজুলের গাছ লাগানো ও তার প্রতি কর্তৃপক্ষের কৃতজ্ঞতাপত্রের সত্যতা স্বীকার করে বাংলানিউজকে জানান, রাস্তা সওজের অথচ জাল কাগজপত্র দেখিয়ে জেলা পরিষদ রাতারাতি রাস্তা পার্শ্ববর্তী গাছের মালিক হয়ে যাওয়ায় আজিজুলের ফল অধিকার খর্ব হয়েছে। জায়গা ও গাছের মালিকানা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। মেহেরপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়ামত উল্ল্যা ভুঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, ওই রাস্তার সব গাছ আজিজুল হক মাস্টার লাগিয়েছেন সত্য। কিন্তু ফলকর ইজারা বন্দোবস্ত নিয়মের কারণে আজিজুল বা ওই গ্রামের লোক ফল-অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ সময় ২১০০ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১১ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad