ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

‘অধিকার লড়ে নিতে হয়’

সোহেল রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১১
‘অধিকার লড়ে নিতে হয়’

ঢাকা: আট বছরের সুমিতের বাবা বাগানের মালী, মা পরিচ্ছন্নতাকর্মী। সুদূর নীলফামারী থেকে সে এসেছে বাবা-মার সাথে।

মা‘র কোলে বসে স্লোগানে তাল মিলিয়ে ছোট্ট সুমিতও বলে উঠছে ‘মর্যাদার সাথে বাচঁতে চাই , সকল ক্ষেত্রে সুযোগ চাই। ’

‘মানুষ হয়েও আমরা মানুষের মত বাচঁতে পারি না। আমাদের কাজের মাধ্যমে আমরা সমাজকে পরিচ্ছন্ন রাখি। আর সে সমাজ আমাদের অপরিচ্ছন্ন মনে করে। অস্পৃশ্য করে রাখে। নিজেদের অধিকারের কথা বলতে এসেছি এখানে। ’ বাংলানিউজকে কথাগুলো বলছিলেন সুমিতের মা শেফালী।

শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিশু একাডেমিতে ছিল হরিজন-দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ভিড়। জাতীয় হরিজন-দলিত সম্মেলনে যোগ দিতে তারা প্রায় পাচঁ হাজারের মত মানুষ এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে।

বঞ্চনার আর্তনাদ সবার চোখে-মুখে। সেইসঙ্গে সবার কন্ঠস্বরে। অধিকার আদায়ের প্রত্যয়। অপ্রাপ্তি আর হতাশা দূরে ঠেলে তারা এখন ঘুরে দাড়াঁতে চায়। হয়ে উঠতে চায় এক একজন যোদ্ধা । তাদের এ অনুভুতি বেরিয়ে প্রকাশ পায় শিশু একাডেমী মিলনায়তনের চারপাশের ঝুলানো ব্যানার,ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডে।   তাতে লেখা: ‘অধিকার কেড়ে নিতে হয়, অধিকার লড়ে নিতে হয়’। ‘মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় চাই  বৈষম্য নিরোধ আইন’ ইত্যাদি সেøাগান।

জানা যায়, বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫৫ লাখ। দলিত গোষ্ঠীর বসবাসের মধ্যে হরিজন, ঋষি, রবিদাস, জেলে, সন্ন্যাসী, বেহারা, দায়,ধোপা, হাজাম,নিকারী, শিকারী, কায়পুত্র,নমশুদ্র,তেলী, শব্দকর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

৬০ বছরের শিবু চন্দ্র দাস গানের শিক্ষক। এসেছেন পাবনা থেকে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘ভোটের সময় আমরা গোনার মধ্যে পড়ি। আর বাকি সময় আমরা থাকি অস্পৃশ্য। সাধারণ মন্দিরে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। ’
 
দলিত জনগোষ্ঠীর অভিযোগ, বৃহত্তর সমাজের কাছে তারা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হন। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন  হয়ে তাদের জীবন পার করতে হয়। এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক। অন্য জনগোষ্ঠীর সাথে মেশা, নলকুপের পানি নেয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবার এবং ন্যায় বিচার ও নিরাপত্তা পাবার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত।

দলিত শিশুরা স্কুলে ভর্তি হতে পারলেও প্রতিক’ল পরিবেশের ফলে ঝরে পড়ে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে তারা চাকুরী পায় না। মজুরির ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

সম্মেলনে অংশ নেওয়া হরিজন সম্পদায়ের মানুষরা জানায়, পুরুষানুক্রমে তারা সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসহ বিভিন্ন পাবলিক প্রাইভেট সেক্টরে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি দেওয়া হয় মাত্র ৩ শ টাকা থেকে ১হাজার টাকা পর্যন্ত। শহর বা গ্রামের একটি নির্দিষ্ট স্থানে তাদের থাকতে বাধ্য করা হয়। ঘৃণার চোখেই তাদের আবাসস্থলগুলোকে মেথরপট্টি,সুইপার কলোনি, মুচিপাড়া ইত্যাদি নামে দেওয়া হয়।

হরিজন ঐক্য পরিষদের নেতা নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমরা দারিদ্রপীড়িত বলে অস্পৃশ্য নই, বরং অস্পৃশ্য বলেই দারিদ্র্যে নিপতিত। এর মূল হচ্ছে ধর্ম ও রাজনীতি যা মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা তৈরি করেছে। ’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে হরিজন ও দলিত জনগোষ্ঠী সবসময়ই জাতীয় উন্নয়নের সব পরিকল্পনা থেকে বাদ পড়েছে। সব দিক থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। ’ তাদের অধিকার আদায়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয় বলে তিনি জানান।  
    
বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় এ সম্মেলনের। সাদা টি শার্ট পড়ে হাতে ফেস্টুন ব্যানার নিয়ে এতে অংশ নেয় হাজারো শিশু-কিশোর যুবক ও বৃদ্ধ।

পরে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় তারা তুলে ধরেন তাদের বঞ্চিত হওয়ার গল্প। নানা সমস্যা ও দু:খের কথা। সম্মেলনের প্রধান অতিথি সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ আশ্বাস দিলেন দাবি পূরণের। বললেন, তাদের জন্য নেওয়া নানা সরকারী উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের কথা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা,জুন ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।