ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

বিজ্ঞাপন-তারকা রবীন্দ্রনাথ

আহমেদ জুয়েল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১০
বিজ্ঞাপন-তারকা রবীন্দ্রনাথ

আমরা যেখানেই যাই না কেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সঙ্গে থাকেন। কারণ আমাদের ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি, সমাজ, শিক্ষা, দর্শন আর রাজনীতির সঙ্গে তিনি জড়িয়ে আছেন।

আর তাই যদি প্রশ্ন করা হয়, কোথায় রবীন্দ্রনাথ নেই? তাহলে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে আমাদের বেগ পেতে হবে অবশ্যই।

স্থূ’ল চোখেই দেখা যায়, এই যুগে এসেও তার  জনপ্রিয়তার রঙ চটেনি এতটুকু। বলতে গেলে আগের চেয়ে তার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে বরং। তার কর্ম ও জীবন সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের উৎসাহ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তাকে নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ। তার জীবন ঘেঁটে অনেকেই বের করে আনার চেষ্টা করছেন অন্য রবীন্দ্রনাথ, অজানা রবীন্দ্রনাথকে। কারণ রবীন্দ্র-জীবনের এমন অনেক বিস্তৃত কিংবা ছোট্ট বিষয় আছে যা হয়তো কখনো আলোচনাতেই আসেনি।

রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের যে বিষয়গুলো কখনোই আলোচনায় আসেনি তেমনই একটি বিষয় সম্প্রতি আলোচনায় এনেছেন কলকাতার একজন সম্পাদক। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি অত্যন্ত সাধারণ হলেও তা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ-চেতনায় লাগিয়েছে নতুন রঙ। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেলজয়ী এই কবির জীবনের সেই অপরিচিত দিকটি হলো, জীবদ্দশায় তিনি পণ্যের বিজ্ঞাপনের অত্যন্ত জনপ্রিয় তারকা ছিলেন। আজকালকার দিনে বিজ্ঞাপন জগতে সিনেমার নায়ক-নায়িকা আর ক্রিকেটারদের জনপ্রিয়তা যেমন আকাশছোঁয়া, ঠিক তেমনি। আর রবীন্দ্রনাথ যে পণ্যের বিজ্ঞাপন করতেন তার কাটতিও বেড়ে যেত হু হু করে। অনেকেই হয়তো কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই গুল নয়। কারণ গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, অন্তত একশটি পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে তা অবশ্যই টেলিভিশনে নয়, পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের পাতায়। কারণ ভারতবর্ষে টেলিভিশনের যাত্রা তখনও শুরু হয়নি।

কেমন ছিল তাঁর বিজ্ঞাপনের ধরন? একটি মজার নমুনা দিয়ে শুরু করা যাক। লিপটন চায়ের জন্য রবীন্দ্রনাথ-বিরচিত বিজ্ঞাপন:
চা-স্পৃহ চঞ্চল
চাতকদল চল
কাতলি-জল তল
কলকল হে...

বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে যে, রবীন্দ্রনাথ একজন অতি-উৎসাহী চা-প্রেমী। ফলে সেই সময়ের চা-খোর শৌখিন মানুষদের মধ্যেও তা ব্যাপক সাড়া জাগায়।

রবীন্দ্রনাথের ওই চায়ের বিজ্ঞাপন সম্পর্কে লিপটন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল এরকম, ‘আমাদের চায়ের সঙ্গে সরাসরি তার নাম যুক্ত করার বিষয়ে আমাদের ইতস্তত বোধ করা উচিত। কিন্তু আমাদের ভাবতে ভালো লাগছে যে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চায়ের মধ্যে লিপটনই একমাত্র কবিগুরুর সমর্থন লাভ করতে পেরেছে’।

লিপটন কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্য থেকেই অনুমান করা যায়, পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় তারকা ছিলেন।

পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করেছেন কলকাতার মাসিক ‘পূরশ্রী’ পত্রিকার সম্পাদক অরুণ কুমার রায়। তার তথ্য অনুযায়ী, ১৮৮৯ থেকে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ অংশ নিয়েছেন। ঘি থেকে ত্বকের ক্রিম, মিষ্টি থেকে হারমোনিয়াম কোনোকিছুই বাদ নেই এর মধ্যে। তবে মডেলরা যেভাবে অঙ্গভঙ্গি করে মনমাতানো হাসির ঝিলিক দিয়ে বিজ্ঞাপন করেন, ঠাকুরমশাই নিশ্চয়ই ওভাবে বিজ্ঞাপন করেননি। বিজ্ঞাপনে থাকত তার সেই বিখ্যাত গোঁফ-দাড়িওয়ালা ছবি আর স্বাক্ষরসহ ওই পণ্য সম্পর্কে কিছু কথা। তবে বিজ্ঞাপনের জন্য লিখে দেওয়া বাণীতে তিনি যে স্রেফ পণ্যের গুণগান গেয়েছেন তা কিন্তু নয়। ওইসব বাণীর মধ্যে ছিল রস, বুদ্ধিমত্তা, ছন্দ, শ্রুতিমধুরতা, দেশপ্রেম আর থাকত একটা দৃশ্য বা সমাজের কোনো একটি দিকের প্রতি ইঙ্গিত। এছাড়া স্বদেশি শিল্পাদ্যোগকে উৎসাহ দিতে এবং তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই তিনি দেশীয় পণ্যের জন্য বাণী লিখে দিতেন। ব্যবসায়ীরা এগুলোকে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করতেন।

তাই যে কোনো দিক থেকেই চলচ্চিত্র কিংবা খেলুড়ে তারকাদের বিজ্ঞাপনের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপনের দূরত্ব অনেক।   এক্ষেত্রে তার কিছু বিষয় অবশ্যই পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠিত। কারণ ব্যাপক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য তিনি কোটি টাকা বা একশ বছর আগে তার সমপরিমাণ অর্থও নেননি। নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় পণ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি জাতীয়ভাবে তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

যদিও ওইসব বিজ্ঞাপনের ভাষা তার কাজের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। তবু সেগুলোর শব্দ এবং ভাষায় রবীন্দ্রনাথের ভাষাশৈলীর ক্ষমতারই প্রকাশ পাওয়া যায়। তার বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল সংহত, সাজানো-গোছানো। সংক্ষেপে সারকথাটুকুই বলতে চেয়েছেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপন ছিল জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জন্য। ওই বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর আলাদা স্বাদ আছে। ...’ ।

তবে মজার বিষয় জলযোগ সেই সময় কিংবা এখনো মিষ্টির জন্য বিখ্যাত নয়। এর তৈরি কেক জনপ্রিয়।

দেশীয় পণ্য হিসেবে রেডিয়াম ক্রিম এবং শ্রীঘৃতের জন্যও তিনি বিজ্ঞাপন করেছেন। বর্তমানে বাজারে শ্রীঘৃত পাওয়া গেলেও রেডিয়াম ক্রিম আর পাওয়া যায় না।

শ্রীঘৃত সম্পর্কে তিনি লিখে দেন, ‘বাংলায় ঘিয়ের ভেজাল বাঙালির অন্ত্রের ভেজালকেও অনিবার্য করে তুলেছে। আমি আশা করি শ্রীঘৃত বাঙালির এই ভেজাল রোগের প্রতিকার করবে’।

রেডিয়াম ক্রিম সম্পর্কে তিনি লেখেন, ‘রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না। ’

সেই সময় লেখার জন্য বাজারে সুলেখা কালি পাওয়া যেত। এই কালি কোম্পানিও যেভাবেই হোক তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য তারকা হিসেবে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন, ‘সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো। ’ মাত্র দুটি বাক্য। শব্দ সংখ্যা সাত। কালির বিজ্ঞাপনের ভাষা এর চেয়ে আকর্ষণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত আর ছোট করা বোধহয় একেবারেই কঠিন। এখানেই রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব যে তিনিই প্রথম বাংলায় বিজ্ঞাপনের ভাষা তৈরি করেছিলেন। আর বিজ্ঞাপনের ভাষা কতটা সংক্ষিপ্ত আর অর্থবহ হতে হয় তিনিই তা শিখিয়েছিলেন বাঙালিদের। আজও সেই ধারা অব্যাহত আছে। আধুনিক বিজ্ঞাপনেও আমরা দেখি, যে বিজ্ঞাপনের যত অল্প সময় আর অল্প কথায় বেশি বোঝানোর ক্ষমতা আছে, সেই বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি পণ্যও হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।

এভাবেই তিনি সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি, ভোলানাথ দত্ত এন্ড সন’স লিমিটেডের কাগজ এবং ডরকিনস হারমোনিয়াম কোম্পানির জন্যও বাণী লিখে বিজ্ঞাপন করেছিলেন। এমনকি ৮ ধর্মতলার অপেরা পরিচালক হরেন ঘোষের মৃত্যুর পর তার জন্য অর্ঘ্যবাণীও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

সাহিত্যক্ষেত্রে অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণে তার সময়ে পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য তিনিই ছিলেন সবার প্রথম পছন্দ। সেই সময় পণ্যের বিজ্ঞাপনে তার নাম ব্যবহার করা মানে তা ছিল অভিজাত একটি ব্যাপার। তবে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ একাই নন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও অনেক জনপ্রিয় ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের ওই বিজ্ঞাপনগুলো সেই সময়ের ম্যাগাজিন এবং পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে বারবার। প্রবাসী, বসুমতি, কলকাতা মিউনিসিপাল গেজেট, ভাণ্ডার, শনিবারের চিঠি, সাধনা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাসহ আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য স্টেটসম্যান ও অ্যাডভান্সে প্রকাশিত বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের আকর্ষণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেছে বারবার। তবে সংখ্যা অনুযায়ী আনন্দবাজার পত্রিকাতেই সবচেয়ে বেশি ছাপা হয়েছে তার বিজ্ঞাপন।


(ইংরেজি থেকে অনুবাদের কারণে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত রবীন্দ্রনাথের শব্দ ও বাক্য হুবহু লেখা সম্ভব হয়নি। )
কালকাতার দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা অবলম্বনে
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১২১০, আগস্ট ০৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।