ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

আকবর আলীর প্রজন্ম নাইট স্কুল

তপু আহম্মেদ, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩০ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১১
আকবর আলীর প্রজন্ম নাইট স্কুল

অর্থের অভাবে নিজে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে কী স্বপ্ন থেমে থাকতে পারে! চেষ্টা থাকলে পৃথিবীও যে জয় করে নেয়া যায়!  এমনটাই প্রমাণ করলেন টাঙ্গাইলের আকবর আলী ওরফে আশা।

দীর্ঘ তেরো বছর ধরে তিনি নিজের চেষ্টায় শিক্ষার আলো বিতরণ করে চলেছেন গ্রামের নিরক্ষর মানুষদের মাঝে।

কেনো এ ধরনের উদ্যোগ নিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আকবর বলেন, ‘সবাই দেশ নিয়ে কথা বলে। দেশ আমাদের কী দিয়েছে? এই ধরনের প্রশ্ন শুনলে মনে আঘাত পাই। আমি মনে করি- দেশ আমাকে কী দিয়েছে সেটি বড় নয়, আমি দেশের জন্য কী করতে পেরেছি সেটাই বড়। আর এই চিন্তা থেকেই নিজ বাড়িতে ‘‘প্রজন্ম নাইট স্কুল’’ স্থাপন করি নিরক্ষর মানুষদের লেখাপড়া শেখাবো বলে। ’

গ্রাম ঘুরে দেখি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা গ্রামের আকবর আলীর স্কুলের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ বল্লা গ্রাম। এই গ্রামে ঢুকলেই তাঁতের খট্খট্ শব্দ জানিয়ে দেয় সবাই কতটা ব্যস্ত। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলেও গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ লেখাপড়া জানেন না। তাছাড়া প্রচুর তাঁত শ্রমিক কাজ করতে আসে বাইরে জেলাগুলো থেকে। তাদেরও প্রায় সবাই নিরক্ষর। এসব মানুষদের অনেকেই আকবর আলীর প্রজন্ম নাইট স্কুলে পড়ে স্বাক্ষরজ্ঞান লাভ করেছেন।

নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। তাও এই ধরনের উদ্যোগকে কেউ কী নিরুৎসাহিত করেছে কিনা এই প্রশ্ন করলে আকবর আলী হাসতে হাসতে বলেন, ‘প্রথম দিকে এলাকার অনেকেই  এই কাজকে ‘পাগলামি’ আর ছেলে মানুষী বললেও এখন সবাই মুগ্ধ। আমার পাশে সবাই আছেন। আমাকে সহযোগিতা করে গ্রামের সব মানুষ। ’


স্বপ্ন দেখার পরে বাস্তবায়নের পথে যেভাবে যাত্রা শুরু:
বল্লা দক্ষিণ পাড়ার মৃত আব্দুল হালিমের আট ছেলে এক মেয়ের মধ্যে আকবর আলীর অবস্থান সপ্তম। তাঁত শ্রমিক পিতার টানাটানির সংসারে লেখাপড়ার খরচ যোগাতে আকবরকে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কাজ করতে হতো। এই এলাকার অধিকাংশ ছেলেরাই পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁতের কাজ করে থাকে।

আকবর জানালেন, ‘অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় একদিন সকালে বাড়ির কাছে দোকানের সামনে বসে ছিলেন। তখন একটি ছোট শিশু এক টাকা নিয়ে এসে একটি পাউরুটি কিনে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাড়ি চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই শিশুটিকে তার বাবা কান ধরে দোকানের সামনে নিয়ে আসেন। দোকানিকে বলেন ‘ওকে বিড়ি আনতে পাঠিয়েছিলাম কিন্তু পাউরুটি কিনে নিয়ে গেছে। ’ পরে পাউরুটি ফেরত দিয়ে বিড়ি নিয়ে লোকটি বাড়ির দিকে রওনা হন। শিশুটিও কাঁদতে কাঁদতে বাবার পিছু পিছু চলে যায়। ’
 
এ ঘটনা দেখার পর আকবরের মনে দারুন প্রতিক্রিয়া হয়।

আকবর বলেন, ‘সেদিনই আমার মনে হয় লেখাপড়া জানেনা বলেই আজ এ অবস্থা। ছেলের হাতের পাউরুটি ফেরত দিয়ে বিড়ি কিনে খাচ্ছে। সেদিনই মনে মনে সংকল্প করি এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে গ্রামের লোকদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। ’ তাই ৯৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই আকবর আলী শুরু করেন নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। প্রথমে এলাকার নিরক্ষর মানুষদের কোনো এক বাড়িতে জড়ো করে নাম লেখা, চিঠি পড়া ইত্যাদি শেখাতেন। কয়েক বছর এভাবে কাজ করার পর অনেকেই যখন লিখতে পড়তে শিখে ফেলে তখন আস্থা আসে আকবর আলীর প্রতি। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী। ৯৮ সালে নিজ বাড়ির একটি কক্ষে চালু করেন প্রজন্ম নাইট স্কুল।

প্রজন্ম নাইট স্কুলে একদিন:
গত সপ্তাহে এক সন্ধ্যায় আকবর আলীর প্রজন্ম নাইট স্কুলে গিয়ে দেখা যায় বিদ্যুৎ নেই। মোমবাতি জালিয়ে লেখাপড়া শিখছে বিভিন্ন বয়সের ১৭-১৮ জন শিক্ষার্থী। ঘরের বেড়া জুড়ে টাঙানো রয়েছে শিক্ষার নানা উপকরণ। আকবর আলীর সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা উচ্চারণ করছে অ, আ, ই, ঈ।

আলাপকালে আকবর আলী জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনটি শিফটে ক্লাস নেয়া হয়। প্রথম শিফটে যারা অক্ষর চেনেন না তাদের অক্ষর পরিচিতি ও নাম লেখা শেখানো হয়। দ্বিতীয় শিফটে যারা অক্ষর চেনেন এবং কোনো মতে নাম লিখতে পারেন তাদের নাম ঠিকানা, মাস, বারের নাম ইত্যাদি শেখানো হয়। আর তৃতীয় শিফটে শিক্ষার্থীদের চিঠি লেখা, পত্রিকা পড়া এবং যোগ-বিয়োগসহ প্রাথমিক হিসাব যাতে করতে পারে তা শেখানো হয়।

প্রজন্ম নাইট স্কুলের শিক্ষার্থী সুজন মিয়া জানান, ‘তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলায়। বছর খানেক আগে এ এলাকায় তাঁত শ্রমিক হিসেবে এসেছেন। লেখাপড়া জানেন না শুনে আকবর আলী তাকে এই স্কুলে এনে পড়াচ্ছেন। ’ অপর শ্রমিক লালমনির হাটের আইয়ুব আলী বলেন, ‘আকবর স্যারের কারণেই আজ লিখতে পড়তে পারছি। ’

মাসুদ মিয়া নামক এক শিক্ষার্থী জানালেন আকবর আলী তার নাইট স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই খাতাও দিয়ে থাকেন। আকবর আলী জানালেন, ‘সারাদিন টিউশনি এবং তাঁতের সুতা কাটার কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনো মতে স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান নিয়ে দিন চলে যায়। উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এই স্কুল পরিচালনা করেন।

পরিবার ও এলাকার লোকজন যা বললেন :
আকবর আলীর স্ত্রী খাদিজা আক্তার মলি বলেন, ‘প্রথম প্রথম তাঁর এই কাজ ভাল লাগতো না। কিন্তু পরে যখন দেখলাম ওনার পরিশ্রমে অনেক মানুষ লিখতে পড়তে পারছে তখন আমি নিজেও উৎসাহিত হই। তার এই কর্মকান্ড নিয়ে গর্ব করি। ’  

বল্লা মাদ্রাসা দারুল ইসলাম মোহাম্মদিয়ার (আলিম মাদ্রাসা) অধ্যক্ষ মো: লুৎফর রহমান বলেন, ‘আকবর আলী প্রজন্ম নাইট স্কুলের মাধ্যমে এলাকার নিরক্ষরতা দূর করার কাজ করছে। তার স্কুলের কারণে অনেকেই লিখতে পড়তে শিখেছে। আমরা সব সময় তাকে উৎসাহিত করি। ’

অন্যদিকে বল্লা করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত আশরাফি বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সমাজপতিরা যা করতে পারিনি আকবর তা করে আমাদের দেখিয়েছে। সে আমাদের মাঝে আশার সঞ্চার করছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যে এলাকাকে নিরক্ষর মুক্ত করণের কাজ করে যাচ্ছে। ’

অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ছে এর আলো:
আকবর আলীর প্রজন্ম নাইট স্কুলের সুনাম এখন শুধু বল্লা গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তার আলো ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের এলাকা এবং অন্য উপজেলাতেও। ইতঃমধ্যে বল্লার পার্শ্ববর্তী টেংগুরিয়া গ্রামে আকবর আলী নিরক্ষর নারীদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেছেন। এছাড়াও ভাঙ্গাবাড়ি ও ডাবাইল গ্রামে চলছে কার্যক্রম। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার কিছু যুবক বল্লা প্রজন্ম নাইট স্কুল দেখে উৎসাহিত হয়েছেন। তারা আকবরের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে নিজ এলাকায় এ ধরনের স্কুল চালু করেছেন।

আকবর আলী বলেন, ‘১৩ বছরে প্রায় ছয় হাজার লোককে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তুলেছি। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাকে এই স্কুল চালাতে হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষ আমাকে খুব উৎসাহ দেয়। আমার স্বপ্ন হলো, একদিন আমার এলাকার প্রত্যেকটি মানুষকে নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্ত হবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭, মে ৩১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।