ঢাকা, বুধবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২২ মে ২০২৪, ১৩ জিলকদ ১৪৪৫

ফিচার

পহেলা বৈশাখের একাল-সেকাল

সানজিদা সামরিন, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৫
পহেলা বৈশাখের একাল-সেকাল

ঢাকা: পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন।

প্রতিবছরই বাঙালি জাতি এ দিনটিকে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করে।

বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। এজন্য আমাদের সংস্ক‍ৃতির পুরোটা জুড়েই রয়েছে গ্রাম ও গ্রামীণমানুষের জীবনযাত্রা। ফলে আগে বাংলা মাস ধরেই চাষাবাদ, ব্যবসায় ও যাবতীয় উৎসব পালন হতো। প্রাচীনকালে কৃষিকাজই ছিল আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল কাঠামো। তবে সময়ের পালাবদলে আমরা এখন হয়ে পড়েছি অনেকটাই শিল্পকারখানানির্ভর। ফলে বাংলা মাসের চাইতে ইংরেজি বর্ষপঞ্জির প্রতি নির্ভরশীলতা চলে এসেছে।

এতকিছুর পর আজও ঘটা করে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে এর আনুষ্ঠানিকতাও। তবে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার নিজস্ব লৌকিকতা।

গোড়ার দিক থেকেই শুরু করা যাক। অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন মুঘল সম্রাট আকবর। আগে হিজরি সন অনুযায়ী সবকাজ করা হতো। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষিকাজ অর্থাৎ ফসল বোনা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত সময়গুলোর সঙ্গে হিজরি সনের মিল পাওয়া যেত না। কারণ হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল। যা আমাদের দেশের আবহাওয়া ও কৃষিকাজের সঙ্গে মিলতো না। যা কৃষকদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিত। ফলে তারা ঠিক সময়ে খাজনা দিতে পারতেন না। এ সমস্যার সমাধানে আকবর বাংলা পঞ্জিকা দেখে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ১৫৮৪ সাল থেকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সূত্রপাত হয়। তবে ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার দিন থেকেই তা কার্যকর হয়।

সেই থেকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা ও শুল্ক পরিশোধ করা হতো। খাজনা নিতে জমির মালিকরা হিসাবের একটি খাতা তৈরি করতেন। খাতায় খাজনা ও শুল্ক পরিশোধকারীদের নাম ও হালনাগাদ হিসাব লিখে রাখা হতো। যা পরবর্তীতে ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত পায়।

বৈশাখের প্রথম দিনে জমির মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে বকেয়া পাওনা বুঝে নিয়ে তাদের মিষ্টি মুখ করাতেন। পাওনা আদায়ের পাশাপাশি দেনাদারদের আপ্যায়নের বিষয়টি হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তবে বর্তমানে তার সিংহভাগই নেই বললেই চলে। বৈশাখ মাসে গ্রামীণ ব্যবসায়ীরা বকেয়া আদায়ের এই প্রথা ধরে রাখলেও, নগর জীবনে এ ঐতিহ্যের প্রভাব অনেকখানি কমে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও কম্পিউটার ব্যবসায় জীবনে হালখাতার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে এনেছে। এখন ব্যালেন্স হিসাব করে রেডি স্লিপ দেওয়া হয়। তবে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, শাঁখারি বাজার, শ্যামবাজার ও ইসলামপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা হালখাতার ঐতিহ্য খানিক হলেও ধরে রেখেছেন।

নতুন বছরের প্রথম দিনে আগের মতো এখনও বৈশাখী মেলা বসে। কোনো কোনো মেলা একদিনের, তিনদিনের, আবার কোনোটা এক সপ্তাহ  জুড়েও হয়। এছাড়াও বৈশাখ উপলক্ষে শপিংমলগুলোতে মাসব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের উপর ছাড় দেওয়া হয়।

তবে পাল্টেছে মেলার ধরন ও ধারাবাহিকতা। আগে বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের খেলা ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। মেলায় লোকগান ও  পুতুল নাচ ছিল অপরিহার্য অংশ। মেলার অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নাগরদোলায়ও এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া।

পারস্পারিক ভাব বিনিময়, সম্প্রীতি ও ক্রয়-বিক্রয়ের উৎস হিসেবে উদযাপিত হতো এসব মেলা। গোটা বছরের প্রয়োজনীয় উপকরণ মেলা থেকেই কিনতো সবাই। যার প্রভাব গ্রামীণ অর্থনীতিতে ছিল ব্যাপক। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের ঘরে ঘরে কৃষিজ দ্রব্য, কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প, বাঁশ-বেত-পাট শিল্প, মৃৎ শিল্প, চারু ও কারুপণ্য উৎপাদনের ধুম পড়ে যেত। শিল্পের এক বিশাল সমাবেশ ঘটত মেলায়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশজ পণ্যের পাশাপাশি আধুনিক উপাদানও যুক্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিদেশি পণ্যও রয়েছে। যা আগে ছিল না।  

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। বিশেষ করে প্রতিবছর চারুকলা ইনস্টিটিউটের আয়োজনে থাকে বিশেষ বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা।

এছাড়াও রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে থাকে বর্ষবরণ উ‍ৎসব, পান্তা-ইলিশ ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। টেলিভিশনে প্রচারিত হয় নাটক, সিনেমাসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বিশেষ সংখ্যাতো রয়েছেই।

আবহমানকাল থেকে প্রাচীন বাংলায় পালিত হয়ে আসছে নববর্ষ। হয়তো সেই প্রাকৃতিক নিবিড়তা নেই, তারপরও বাংলা নববর্ষ আজও সবার কাছে বিশেষ অর্থ বহন করে।

বাংলাদেশ সময়: ০২৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৫
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।