ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক পূজা

বিপ্লব কুমার পাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১১
চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক পূজা

চৈত্রসংক্রান্তি তিথিতে দেবতাকে তুষ্ট করতে নিজেকে উৎসর্গ করেন বিশ্বনাথ। মহাদেবের মূর্তির সামনে লোহার বড় ‘কালা’ গেঁথে নেন নিজের শরীরে।

এরপর গাছের বড় খুঁটির সঙ্গে বাঁধা দড়িতে ঝুলে শূন্যে ঘোরেন তিনি। মহাদেব খুশি হলেই নতুন বছরে সুখ-শান্তিতে ভরে উঠবে সংসার- এই বিশ্বাস বিশ্বনাথের। বায়ান্ন বছর বয়সী বিশ্বনাথ পাহান ৩৮ বছর ধরে চড়ক পূজার সন্ন্যাসী হয়ে দেবতাকে খুশি করার চেষ্টা করছেন।

রতন তেলি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষিকাজও করে। চড়ক পূজায় অংশ নিতে সেও নিজের পিঠে গেঁথেছে লোহার বড় ‘কালা’। রতন এবার সপ্তমবারের মতো সন্ন্যাসী হলো। রতন বলল, ‘চড়ক পূজায় অংশ নিলে মহাদেব খুশি হবেন। দেবতা খুশি হলে আমাদের সুখ আসবে। তাছাড়া আমার বাবা এবং দাদু চড়ক পূজার সন্ন্যাসী হতেন। সেজন্য আমাকেও সন্ন্যাসী হতে হয়েছে। ’

বিশ্বনাথ ও রতনের মতো অনেকেই চড়ক পূজায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিতে এ উৎসব পালিত হয়। যদিও বাংলা সনের নতুন পঞ্জিকার কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ সময়ের হিসাবে একদিন পিছিয়ে আছে। শহরে যেদিন নতুন বছরকে বরণ করা হয়, সেদিন গ্রামাঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তি পালিত হয়। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পূজা। নাটোর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সাঁওতাল সম্প্রদায় অধ্যুষিত শংকরভাগ গ্রামও তার একটি। এখানকার শিবমন্দিওে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পূজা। কিছু পার্থক্য ছাড়া চড়ক পূজার ধরন সারা দেশে একই।

হাজরা খেলা : হাজরা খেলার মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। তরুণ এবং মধ্যবয়সীরা ঢাকের তালে তালে হাজরা খেলায় মেতে ওঠেন। ‘হর হর মহাদেব’ বলে চিৎকার করে তারা নৃত্য করেন। এ সময় তারা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে যান। বাড়ির মন্দিরের সামনে গিয়ে শুয়ে পড়েন। অনেকে সে সময় গাঁজা সেবন করেন। বাড়ির নারীরা তাদের কলা খাইয়ে দেন। আর পুরুষেরা তাদের শরীরে ঢেলে দেন ঠাণ্ডা জল।   হাজারা দলের একজনের হাতে থাকে লোহার বড় খড়্গ বা খাঁড়া। খড়্গের আঘাতে কেউ যেন আহত না হন, সেজন্য তার কোমরে দড়ি বেঁধে দুজন ধরে রাখেন। দুপুর পর্যন্ত চলে এই খেলা।

অতীতের কথা : ধর্মগ্রন্থে আছে, সন্তান কামনায় স্বর্গের দক্ষরাজা তপস্যা শুরু করেন। প্রার্থনায় খুশি হয়ে বিষ্ণুদেব দক্ষরাজাকে আশীর্বাদ করেন। এরপর দক্ষরাজা কন্যাসন্তানের বাবা হন। কন্যার নাম রাখা হয় সতী। যৌবনপ্রাপ্তির পর মহাদেবের (শিব) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। যদিও এ বিয়েতে পিতা দক্ষরাজার সম্মতি ছিল না।

দক্ষরাজা একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেই যজ্ঞে সব দেব-দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুধু মেয়ে সতী ও জামাতা শিবকে নিমন্ত্রণ করেন না। মেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে যজ্ঞানুষ্ঠানে ছুটে আসেন। তিনি বাবার কাছে জানতে চান, কেন একমাত্র জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি? বাবা তাকে বলেন ‘তোমার স্বামী নেশা করে। তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হলে অন্য দেবতারা অপমানিত হতেন। ’ এ কথা শুনে অনেক দেবতা মহাদেবকে নিয়ে ঠাট্টা করেন। স্বামীর নামে অপবাদ সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করেন।

স্ত্রীর দেহত্যাগের কথা শুনে যজ্ঞানুষ্ঠানে ছুটে আসেন মহাদেব। স্ত্রীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে ফেটে পড়েন তিনি। মহাদেব ক্ষুব্ধ হয়ে একটি দৈত্যের সৃষ্টি করেন। দৈত্য যজ্ঞ লন্ডভ- করে দেয়। মহাদেবের ক্রোধে গোটা ব্রহ্মা- কেঁপে উঠে। দেবতারা চিন্তিত হন। অবশেষে বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে দেন। সতীর দেহের ১০৭টি খ- পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে পড়ে। যেখানে দেহখ- পড়ে সেখানেই তীর্থস্থানে পরিণত হয়। সতীকে কাঁধে নিয়ে মহাদেব যেভাবে ঘুরেছেন তারই অনুকরণে চড়ক পূজার প্রচলন।

চড়কা গাছ : হাজরা খেলা শেষে নাটোর সদর উপজেলার শংকরভাগ চড়ক পুকুরে নেমে পড়েন ভক্তরা। এরপর ঢাকের বাজনা আর উলুধ্বনির মাধ্যমে পুকুর থেকে তুলে আনা হয় চড়কা গাছ। পুকুরের পাড়ে এনে চড়কা গাছকে ঘিরে নারীরা পূজা-অর্চনা করেন। এ প্রসঙ্গে শংকরভাগ শিব পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি হরিপদ পাহান বলেন, ‘চড়কা মূলত কদমগাছের। প্রায় ৫০ বছর পুরনো এই গাছটি পূজার পর পুকুরের জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। চৈত্রসংক্রান্তি তিথিতে গাছটি ডাঙ্গায় তোলা হয়। বংশপরম্পরায় এই গাছকে আমরা পূজা করি। পুকুর থেকে তোলার পর ঘি আর কলা দিয়ে গাছের মাথায় মালিশ করা হয়। এতে গাছের মাথা পিচ্ছিল হয়। তখন খুব সহজে চড়কা গাছ ঘুরতে পারে। ’

প্রায় ২৫ ফুট উঁচু চড়কা গাছটি শংকরভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গর্ত খুঁড়ে বসানো হয়। প্রায় ৭ ফুট গর্তের মধ্যে একজন পুরোহিত পূজা-অর্চনা করেন। সেখানে কবুতর, ঘাসের টুকরো আর ধুপ দিয়ে মন্ত্র পড়া হয়। প্রধান পুরোহিত হারাধন গোস্বামী বলেন, ‘মন্ত্রের মাধ্যমে মাটির গর্তকে পবিত্র করা হয়। এতে চড়কা গাছ খুব সহজে ঘুরবে এবং কারো কোনো অসুবিধা হবে না। ’

পূজা শেষে শঙ্খ, ঢাক আর উলুধ্বনিতে চড়কা গাছ দাঁড় করানো হয়। এ সময় মহাদেবের নাম ধরে প্রার্থনা করা হয়। চড়কা গাছের মাথায় বাঁশের সঙ্গে কৃষ্ণলতা বেঁধে দেওয়া হয়।

শূন্যে ঘোরানো : শিবমন্দিরের উঠোনে সন্ন্যাসীরা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকেন। এ সময় একজন পুরোহিত লোহার তৈরি ‘কালা’ হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়েন। পুরোহিত রঞ্জিত মল্লিক জানান, দেবাদিদেব শিবের পা স্পর্শ করে ‘কালা’র উদ্দেশ্যে মন্ত্র পড়া হয়। শরীরে ‘কালা’ গাঁথার সময় সন্ন্যাসীরা ব্যথা পাবেন না। বাবা শিব তাদের রক্ষা করেন। ’

প্রধান পুরোহিত হারাধন গোস্বামী সন্ন্যাসী বিশ্বনাথ পাহানের পিঠ ভালো করে পরখ করেন। পিঠের যে অংশ দিয়ে ‘কালা’ ফোঁটাবেন সেই স্থানে চুন দিয়ে নির্দিষ্ট করে নেন। পিঠের চামড়া ধরে দ্রুত পরপর দুটি ‘কালা’ গেঁথে দেন।   দুই ‘কালা’ মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে।
এ সময় অন্য লোকজন হাত পাখা দিয়ে বিশ্বনাথকে বাতাস করেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চড়কা গাছের কাছে। সেখানে বাঁশের বারের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকের তালে চড়কা গাছ ঘোরানো হয়। তখন বিশ্বনাথ শূন্যে ভাসতে থাকেন। এভাবে তাকে সাত পাক ঘোরানো হয়। এ সময় তিনি ভক্তদের উদ্দেশ্যে বাতাসা (এক প্রকার মিষ্টি) ছিটিয়ে দেন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন এই ‘বাতাসা’ খেলে নারীরা গর্ভবতী হন। অনেকে সন্তানের মঙ্গল কামনায় সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ নেন।
সন্ন্যাসী বিশ্বনাথ পাহান বলেন, ‘বাবাকে দেখতাম চড়ক পূজা করতেন। এখন আমি করি। ’ লোহার ‘কালা’র আঘাতে কোনো ব্যথা পান না তিনি। বিশ্বনাথ বিশ্বাস করেন সামান্য কষ্ট সহ্য করলে মহাদেব খুশি হবেন। তিনি খুশি হলেই সংসারে শান্তি ফিরে আসবে। বিশ্বনাথের মতো বিভিন্ন বয়সী প্রায় ৩০ জন সন্ন্যাসী এ পূজার অংশ নেন।

চড়কা গাছে ঘোরানোর পর সন্ন্যাসীর পিঠ থেকে ‘কালা’ খুলে নেওয়া হয়। এরপর দুই মুঠো মাটি তার পিঠে লাগানো হয়। চড়কা গাছকে প্রণাম করার পর নারীরা সন্ন্যাসীর পা জল দিয়ে ধুয়ে দিয়ে কলা খাইয়ে দেন। এ সময় সন্ন্যাসীর পিঠের ছিদ্র অংশ দিয়ে ফোটা ফোটা রক্ত বের হয়।

পরদিনে সকালে ঢাকের বাজনা, শঙ্খ আর ঊলুধ্বনির মাধ্যমে চড়কা গাছকে আবারো পূজা করা হয়। এরপর পুকুরের জলে গাছটি ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এক বছর পর চৈত্রসংক্রান্তিতে পুকুর থেকে আবার গাছটি তোলা হবে।

বসনবুড়ি পূজা : এছাড়া চৈত্রসংক্রান্তিতে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় বসনবুড়ি পূজা। অবিবাহিত মেয়েরা এই পূজা করে থাকেন। চৈত্র মাসের প্রথম দিন থেকে এ পূজা শুরু হয়। তিন-চার জন মেয়ে একত্র হয়ে বাড়ির উঠোনে কলাগাছের চারা পুঁতে এ পূজা করেন। চড়ক পূজার দিন পুকুরের জলে কলা গাছের চারাটি বিসর্জন দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সুমিতা রানি বলেন, ‘আমার দিদি এ পূজা করতেন, তাই আমি করি। দেবতা খুশি হলে আমাদের ভালো হবে। ’ সুমিতার বাবা সুরেশ পাহান বলেন, ‘মহাদেব শিবের মতো স্বামী পাওয়ার আশায় অবিবাহিত মেয়েরা এ পূজা করেন। ’

কয়েকটি গ্রামের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় চড়ক পূজা। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ থাকে না এখানে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে উৎসব করেন। চড়ক পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বেলাল তেলি বলেন, ‘বছরের শেষ দিন আমরা হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে মিলিত হই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাধ্যমে সবাই আনন্দ করি। ’

স্থানীয় ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে আমরা এ উৎসব পালন করে আসছি। হিন্দুরা পূজা অর্চনা করে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকি। চৈত্রসংক্রান্তিতে আমাদের একটিই পরিচয়, তা হলো বাঙালি। ’

সরকারি বা বেসকারি কোনো সহযোগিতা ছাড়াই বছরের পর বছর এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে চড়ক পূজা এবং মেলা। এখানে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের আগমন ঘটে। অ্যাডভোকেট স্বপন দাস বলেন, ‘এখন ধর্মের নাম দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে। এরই বিপরীতে শংকরভাগের এই সম্প্রীতির উৎসব বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করে। ’

জানা যায়, কামররূপ কামাখ্যা থেকে ভারতবর্ষে চড়ক পূজা শুরু হয়। বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে চড়ক পূজা দেখা যায়।

বাংলা বর্ষের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিতে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও একে নীলপূজা আবার হাজরা পূজাও বলা হয়। একসময় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এ পূজা করলেও এখন তা বাঙালির মিলন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পটুয়াখালী, পিরোজপুর, দিনাজপুর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, সিলেট, রাজশাহী, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন স্থানে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ সময় ১৯১০, এপ্রিল ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।