বুড়িগঙ্গা দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থেকে ফিরে: একদশক আগেও এ খালে বড় নৌকা চলতো। মাছ ধরতো জেলেরা।
ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জের প্রাচীনতম খাল এই শুভাঢ্যা। বুড়িগঙ্গার শাখা খাল এটি। শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, খালটির ডানে জেলা পরিষদ মার্কেট আর বামে আহসান উল্লাহ চৌধুরী মার্কেট। এ দুই মার্কেটের মলমূত্রসহ সব আবর্জনা আর কঠিন-তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই খালে। সেই আবর্জনা নিয়েই বুড়িগঙ্গায় প্রবেশ করেছে শুভাঢ্যা খালটি।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, খালের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। নিকষ কালো দূষিত পানির উৎকট দুর্গন্ধ আর মশার উৎপাতে চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন খালের দুই পাড়ের বাসিন্দারা। অবশ্য এজন্য তারাও তো কম দায়ী নন। ভোগান্তিটা তাদেরও কাজের ফল অনেকটা। তাই বলাই যায়, তাদের নিজেদের বর্জ্য ফেলার বদভ্যাসটাই ভোগান্তির বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে তাদের দিকে। স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি একই সঙ্গে ছিল জনবহুল কেরানীগঞ্জের কৃষি ও গৃহস্থালি কাজের পানির অন্যতম প্রধান উৎস। এটি ছিল বুড়িগঙ্গার কালীগঞ্জ স্লুইসগেট থেকে শুরু হয়ে তেঘরিয়া-পশ্চিমদী এলাকা হয়ে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান সময়ে এসে এটি পরিণত হয়েছে কেরানীগঞ্জের অন্যতম দূষণ-অঞ্চলে।
কদমতলী, গোলামবাজার, ঝাউবাড়ী, নতুন শুভাঢ্যা, চরকুতুব, কালীগঞ্জ এলাকাজুড়ে খালপাড়ের দুই পাশের তৈরিপোশাক কারখানার উচ্ছিষ্ট ঝুট ও টুকরা কাপড়, গৃহস্থালিবর্জ্যে শুভাঢ্যা এখন বিশাল এক আঁস্তাকুড়। খালপাড়ে বাড়িঘর, দোকানপাট গড়ে তুলেছে দখলদাররা। শুভাঢ্যা খাল উদ্ধারে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রভাবশালী দখলদারদের দাপটে তা ফলপ্রসূ হয়নি।
শুভাঢ্যা খালের এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জলবায়ু তহবিলের প্রায় ১০ কোটি টাকায় ‘শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধার প্রকল্প’গ্রহণ করে। এতে আশায় বুক বাঁধেন কেরানীগঞ্জবাসী। কিন্তু সব আশা এখন গুড়েবালি। প্রকল্প নেওয়ার প্রায় এক বছরেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।
শুভাঢ্যা খালের সামনে কথা হয় প্রকল্পটির সাইট ম্যানাজার মোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা একদিকে ময়লা পরিষ্কার করছি খাল থেকে, আরেক দিকে ময়লা ফেলা হচ্ছে। এতে প্রকল্পের কাজেই বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ’
পাউবোর প্রকল্প পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, শুভাঢ্যার প্রাণ ফিরিয়ে এনে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাই শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধার প্রকল্পের লক্ষ্য। এজন্য ব্যয় হবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু তহবিলের প্রায় ১০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় শুভাঢ্যা থেকে আগানগর এলাকা পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার খালটি পুনর্খনন করে এর তীর সংরক্ষণ করা হবে। আর প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক বছরে এ প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ অর্থে পাউবো শুভাঢ্যার দখল উচ্ছেদের পাশাপাশি খালটি পুনর্খননের কাজ সহজেই করতে পারতো। কিন্তু তারা পুরো টাকাটাই ব্যয় করেছে কংক্রিটের ব্লক নির্মাণের কাজে। আর খালটি দখল-দূষণমুক্ত না করায় এসব ব্লক এখন কোনো কাজেই আসবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যৌথ বাহিনী বুড়িগঙ্গা নদীর মুখ থেকে চরকালীগঞ্জ এলাকা হয়ে গোলামবাজার পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ শুভাঢ্যা খালে খালের দুই পাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। প্রায় ১৮৬টি ছোট-বড় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সে সময় পুনর্খনন করে কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা হয় খালের নাব্যতা। কিন্তু দেখভালের অভাবে আবারও দখল-দূষণের শিকার হয় খালটি। ২০১২ সালের জুলাই মাসে কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ৫৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে খালটি পুনরুদ্ধারে অভিযান চালায়। মাসখানেক ধরে চলে খাল খনন। কিন্তু আবারও অবহেলায় কয়েক মাসের মধ্যেই দখল-দূষণে খালটি হয়ে পড়ে আগের মতোই ভরাট ও মৃত।
এখন যে প্রকল্পটা চলছে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে সেটার কাজ অন্তত পুরোপুরি শেষ করার চেষ্টা করা। কিন্তু সেটা কি আদৌ হবে? যদি না হয় তাহলে সবই ‘থোড় বড়ি খাড়া/খাড়া কড়ি থোড়’-হয়েই থাকবে অন্য অনেক প্রকল্প নাটকের মতো। ‘লাগে টাকা দেবে গৌরিসেন’ –এ জাতীয় রসিকতা অন্তত জনগণ আর শুনতে চায় না।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৪