ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

আনন্দের সঙ্গে পড়া

আরিফুল ইসলাম আরমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩২ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১১
আনন্দের সঙ্গে পড়া

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ছোট্ট গ্রাম মোগরখাল। শিল্পনগরী গাজীপুরের আধাপাকা রাস্তা দিয়ে কিছু পথ পেরোলেই মোগরখাল রেজিস্ট্রার্ড কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

রাস্তার সঙ্গেই মাঠ, তারপরেই স্কুল।

স্কুল থেকে হৈ হুল্লোড়

মাঠ পেরিয়ে স্কুলের কাছে পৌঁছতেই শোনা যাবে শিশুদের হুল্লোড়। ক্লাসের জানালার পাশে দেখা যাবে গ্রাম্যবধূর ভিড়। এরা মোগলখালেরই এপাড়া ওপাড়ার মানুষ। নাজনীন নাহারের (৩০) মতো যারা ৫ বছরের ছোট্ট মেয়ে বা ছেলেকে নিয়ে প্রতিদিনই স্কুলে আসেন। বেলা ১২টায় স্কুলের শিশুশ্রেণীর ছুটি হলে নিজের সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। শাহিদা (৩২), উম্মে কুলসুম (২৭), রোজিনা বেগম (৩০), করিমন (২৮), ষাটোর্ধ্ব আনোয়ারা খাতুন এমনই অভিভাবক।

শিশু অভিভাবক সুফিয়া আক্তার (২৯) জানান, ‘এখানে ছোডগো কেলাস হইতাছে। খেলাইয়ে খেলাইয়ে পড়তাছে। তাই আমরা দেখতাছি। আমার মাইয়্যাও আছে। ’ শিশুশ্রেণীর একমাত্র শিক্ষিকা নাসিমা আক্তার জানান, ‘শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশের লক্ষ্যে এই শ্রেণীতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষার বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে খেলার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষার মৌলিক কিছু বিষয় শেখানো হয়। ৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সী শিশুরাই এখানে পড়ার সুযোগ পায়। সরকারি ছুটি ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত স্কুল চলে। ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে পরিচালিত এই শ্রেণীর নাম ‘শিশুশ্রেণী’।

সম্ভাবনার দুয়ার খুলে

শিশুশ্রেণীতে শিক্ষিকা নাসিমার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ৩২জন শিশু শিক্ষার্থীর সবাই সুর মিলিয়ে পড়ে ‘আমপাতা জোড়া জোড়া, মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া....। ’ ছড়া পড়া শেষ হতে না হতেই বসে গল্প শোনার আসর। খরগোশ কচ্ছপের সেই গল্পের ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে গল্প শোনান ‘নাসিমা ম্যাডাম’। পড়তে পড়তে কারো বাইরে যেতে ইচ্ছা করলে রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। কারো বা পড়তে ইচ্ছা না করলে চলে যায় বাড়িতে। মনে তাদের অনেক আনন্দ। আনন্দ অভিভাবকদের মাঝেও। নয়তো বা ঘরের কাজ ফেলে কেনই বা ছোট্ট শিশুকে নিয়ে এই স্কুল আসেন। এমনটাই জানান শিশু অভিভাবক রোজিনা বেগম।

কনক্রিট নয়, কাঠের বাড়ি

স্বাভাবিক পড়াশোনার বাইরে শিশুরা খেলে পুতুল। কেউ বা ইট-বালুর পরিবর্তে কাঠের ব্লক দিয়ে তৈরি করে ঘর-বাড়ি। কেউ পানি দিয়ে তরল পদার্থ পরিমাপ করে। অনেকে আবার নতুন নতুন চক আর ব্ল্যাকবোর্ড পেয়ে মন খুলে লিখে মনের সব ভাবনা ‘অ, আ, ই, ঈ...’। এভাবেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শিশুশ্রেণীতে দিনে তিনটি ঘণ্টা কাটে শিশুদের।

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর নিয়মিত শ্রেণীগুলোর পাশাপাশি নতুন এই শ্রেণীটি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন-ইউএসএ। ইউএসএইডের সহযোগিতায় দেশের ২১টি জেলায় ১২৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রি-প্রাইমারি স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে চলছে এই কার্যক্রম। এর মাধ্যমে শিশুকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির আগেই ভর্তির উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এর লক্ষ্য, শিশুর সঙ্গে সমাজ আর সমাজের মানুষের সঙ্গে সামাজিকীকরণের নতুন যাত্রা শুরু করা, যার মাধ্যমে শিশু গড়বে তার কাক্সিক্ষত স্বদেশ। এর ফলাফলও চমৎকার। শিশুশ্রেণীর নতুন এই শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের মনে শিক্ষা নিয়ে নতুন এক ধারণার জন্ম দিচ্ছে। সেজন্যই দেখা যায়, মোগরখাল রেজিস্ট্রার্ড কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুশ্রেণীর ৩২জন শিশুর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন শিশু উপস্থিত থাকে। তবে শুধু মোগারখাল নয়, এর থেকে কিছুটা দূরে ‘প্রি-প্রাইমারি স্কুল’ নামে আরেকটি বিদ্যালয়ের শিশুশ্রেণীর চিত্রটা এমনই।
শিশুশ্রেণীর শিক্ষার্থী আফিয়া (৫) জানায়, ‘স্কুলে আসতে আমার খুবই ভালো লাগে। এখানে এসে আমি অনেক কিছু খেলি। পুতুল বানাই, ঘর বানাই, অ আ খেলি। আমার মজাও লাগে। ’
 
আলোর স্কুল

আসছে নতুন শিক্ষানীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সৃজনশীল শিক্ষা। শিক্ষানীতি প্রণেতাদের মতে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যতদিন সৃজনশীল শিক্ষা চালু না হবে ততদিন শিক্ষায় কাক্সিক্ষত অর্জন সম্ভব হবে না। সেভ দ্য চিলড্রেন-এর উদ্যোগ দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ও এর আশপাশে শিশুশ্রেণী এবং প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো স্থাপনের মাধ্যমে শিশুদের এই সৃজনশীল শিক্ষাই দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই জানান মোগরখাল রেজিস্ট্রার্ড কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন। তিনি আরও জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমার স্কুলে শিশুশ্রেণী চালু হয়েছে। চালু হওয়ার আগেই আমরা স্থানীয়দের জানিয়েছি। তাদের ৫ বছরের শিশুকে এই শিশুশ্রেণীতে ভর্তি করার আহ্বান জানিয়েছি। এজন্য কার্যক্রমটি চালুর প্রথম সাত দিনেই আমরা ২০ জনেরও বেশি শিশু শিক্ষার্থী পেয়েছি, যারা এখনো আছে। প্রতিদিনই আরও নতুন শিশু আসছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আমরা শিশুদের আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষাদান করছি।

একই স্কুলের শিক্ষিকা নাসিমা আক্তার জানান, শিশুদের পড়ানোর মজাই আলাদা। তবে ওদেরকে ওদের মতোই চলতে দেওয়া উচিত। আমরা কখনো শিশুশ্রেণীর শিক্ষার্থীকে কোনোরকম কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকি। তাদের যা করতে ইচ্ছে হয়, তাই করতে দিই। যখন সবাই এলোমেলোভাবে অনেক কিছু করার চেষ্টা করে তখন তাদের গল্প শোনাই। গল্প শুনলে শিশুরা খুবই আনন্দ পায়। আর এসব গল্পের অধিকাংশই হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর বই থেকে নেওয়া। এর কারণ হচ্ছে শিশুশ্রেণীর পর তারা প্রথম শ্রেণীতেই ভর্তি হবে। সে সময় তাদের এই গল্পটি দ্বিতীয়বার আর পড়তে হবে না।

ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

নিজ গ্রামের শিশুদের জন্য এ ধরনের একটি উদ্যোগ দেখে খুব খুশি মোগরখাল রেজিস্ট্রার্ড কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আলহাজ আবুল হোসেন। তিনি জানান, ১৯৯৫ সালে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে যতগুলো ভালো কাজ হয়েছে তার মধ্যে শিশুশ্রেণী একটি অনন্য উদ্যোগ। এর মাধ্যমে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা সম্পর্কে ভালো মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগবে। সব স্কুল পরিচালনা পরিষদের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারিভাবে এ ধরনের শিশুশ্রেণী স্থায়ীভাবে চালু করা দরকার।

শিশুশ্রেণী চালুর উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন-এর সহকারী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক জাফর উল্লাহ নিজাম জানান, শিশুশ্রেণীগুলো বিভিন্ন দাতাসংস্থার সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। সরকারিভাবে এই শ্রেণীটি চালু হলে শিশুরা খুবই উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০১৫, মার্চ ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।