ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

রাজশাহীর পুঠিয়ার মন্দিরগুলো

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১১
রাজশাহীর পুঠিয়ার মন্দিরগুলো

ছোটবেলায় আমরা প্রায়ই চিড়িয়াখানায় যেতাম। জাদুঘরেও যাওয়া হতো।

অধিকাংশ সময় যাওয়া হতো স্কুল থেকে। আমার স্কুল শুরু অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশানাল স্কুল দিয়ে। এই স্কুলটা আগে লালমাটিয়ার একটি ভাড়া করা বাড়িতে খুবই ছোট্ট পরিসরে শুরু করেছিল। যে বছর এই স্কুলটি চালু হয় ঐ বছরই আমি এবং আমার বোন ভর্তি হই।

যাইহোক। সে অন্য কথা। অক্সফোর্ড থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হতো চিড়িয়াখানায়। নিয়ে কাজ ছিল একটা কাগজে সব জন্তগুলোর নাম লিখে নেওয়া। এবং কে কেমন দেখতে তা মনে রাখা। পরের দিনই স্কুলে পড়া ধরা হতো। ধরুণ,  টিচার প্রশ্ন করতো, শেরিফ বলো তো ‘ঊ’ দিয়ে তুমি কি দেখেছ? তারপরের প্রশ্ন- দেখতে কেমন ছিল? ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার জাদুঘরে গেলেও একই অবস্থা। তবে চিড়িয়াখানার চাইতে জাদুঘরে গিয়ে আমার খুব ভালো লাগতো। আমি কখনও জাদুঘরে নোট নেইনি। অবাক হয়ে দেখতাম গাইড যারা আছেন তারা খুব সুন্দর করে বর্ণনা করতেন প্রতিটি বিষয়বস্তু। বের হয়ে ভুলেও যেতাম ভেতরে কি দেখেছি। তবে যতটুকু মনে আছে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আর অবাক হতাম।

আসলে কোথাও গিয়ে যদি কিছুর নোট নিতে হয় তবে মুগ্ধ হওয়াটা অনেকটা ফিকে হয়ে যায়। শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড খোঁজার তালে তালে মুগ্ধ হওয়াটা বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমি কোথাও ঘুরতে গেলে শুধু উপভোগ করি। কারণ তথ্য নিতে গেলে উপভোগের ব্যপারটা আমি পাই না। তখন ভাবনা এসে জড়ো হয়। ভাবনা আসলেই একটা যন্ত্রণা।

ইতিহাস জানার যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ তা যাদের জানার আগ্রহটা একটু বেশি তারাই বলতে পারবেন। অনেক সময় আমি আবার চুপচাপ বসে বসে নিজের কাজটাও সেরে ফেলি। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ফেলি। তবে এটা সম্পূর্ণ ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। যখন আমার মনে হয়, এটা সম্পূর্ণ নতুন কিছু তখন আমি নিজের ভেতরই অনুভব করি- কিছু একটা করা উচিত। তখন হাতিয়ে বেড়াই। তবে যতটুকু পর্যন্ত আমি পারি। এর বেশি কিছুই না।

বেশ কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা রাজশাহির পুঠিয়ায় জমিদার বাড়িতে গিয়ে আমি রীতিমত আবিষ্কার করলাম একসময় হিন্দু সম্প্রদায় কতটা মজবুত ভিত নিয়ে এদেশে অবস্থান করত। একটার পর একটা ধর্মীয় উপসনালয়গুলো দেখে আমি শুধু অবাকই হইনি বরং নিজের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ উপলব্ধি করলাম এই বিষয়ে আরও কিছু তথ্য জানবার জন্য।

প্রথমেই আসি গোবিন্দ মন্দির। ইটের নির্মিত বাহুর উপর এই মন্দিরটি অবস্থিত। সবচাইতে দেখার মতো বিষয় ছিল, দেয়ালে পোড়ামাটির তৈরি চিত্রফলক। এই চিত্রফলকগুলোতে রামায়ণ ও মহাভারত, হিন্দু পৌরানিকসহ অনেক কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। দেয়ালে খচিত এই চিত্রকর্মগুলো যে কেউ দেখে মুগ্ধ হবে। তারপর আমরা ঢুকি রাজবাড়িতে। ঢুকতেই আমি অবাক। দেয়ালে খোদাই করে লেখা-

THE PALACE
CONSTRUCTED IN 1895 A.D BY
RANI HEMANTA KUMARI DEVI
In Honor of Her Mother in Law
Late Maharani Sharut Sundari Devi

S.M. Mukbul Ali, Architect, Calcutta

পুরই স্মৃতিমন্থন। আমি যেন বার বার চলে যাচ্ছিলাম সেই ১৮৯৫ সালে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই বাড়িটি রাজা পরেশ নারায়ণ বাহাদুর সাহেবের। আরও অবাক হই যখন শুনি তার কন্যা এখনও বেঁচে আছে। থাকেন কলকাতায়। রাজা বাহাদুরের নাতনীও বেঁচে আছেন। তিনি থাকেন আমেরিকায়। প্রতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য তিনি নাকি টাকা পয়সা পাঠিয়ে থাকেন। প্রতি বছর `বমবম` উৎসব নামে এখানে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মুসলিম-হিন্দু সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করে। এবং গতবছর রাজা বাহাদুরের নাতনী এই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। রাজার বংশধর বলে কথা। পুরো গ্রামবাসীর উপচে পড়া ভীড়ে হিমসিম খেতে থাকেন সকলে। রাজার নাতনী অধিকাংশ মানুষকে আমেরিকান ডলার দিয়ে সহযোগিতা করেন।

আমি গাইডকে প্রশ্ন করি, রাজার বংশধররা কি তাদের এই জমি-জমা সরকারের কাছে দাবি করে না?  তিনি বললেন, নাহ করে না। বরং তারা এতোদিন চাইতো এই সম্পত্তি যাতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতাধীন চলে যায়। এর আগে স্থানীয় মানুষজনই এর দেখভাল করতো। এই নিয়ে রাজার বংশধরেরা খুব কষ্ট পেতো। তারা এমনও উদ্যোগ নিয়েছিল যে, তারাই তাদের অর্থ দিয়ে সব সংরক্ষণ করবে। কিন্তু সরকার অঙ্গিকার করেছিল যে, তাদের এই সম্পত্তি সরকার দেখাশোনা করবে। অবশেষে তাই হলো। এখন এই সব সম্পত্তি সরকারের আওতাধীন চলে যাচ্ছে।

আমরা এবার যাই প্রাসাদটির পিছন-প্রান্তে। রানির জন্য বাঁধানো পুকুর-ঘাটটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। ধ্বংস স্তুপে পরিণত হওয়ার কথা।   শেওলা পড়ে গেছে। কিন্তু মজবুত ইটের দালান এখনও বেঁচে আছে। বেঁচে আছে আহ্নিক মন্দিরটিও। রানি স্নান সেরে আহ্নিক মন্দিরে যেতেন পূজা করতে। আহ্নিক মন্দিরটির ঠিক সামনে আরেকটি দালানের বাড়ি। আধুনিক স্টাইলে করা এই বাড়িটি দেখলে বোঝা যাবে মূল প্রসাদের সাথে এর কোন মিল নেই। তথ্য নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, এই বাড়িটি ১৯৪৭-এর দিকে করা। নতুন এই বাড়িতে রাজা থাকতে পারেননি। দেশভাগের পর তাকে চলে যেতে হয়েছে কলকাতায়।
 
আমাদের অবাক হওয়া তখনও বাকি। আমরা যাচ্ছি বড় শিব মন্দিরের দিকে। মাটি থেকে প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতায় এই মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরে ওঠার জন্য দক্ষিণ ও উত্তর পার্শ্বে রয়েছে উঁচু সিড়ি। মন্দিরটি এক বিরাট দীঘির পাড়ে অবস্থিত। এই মন্দিরটি ১৮২৩ সালে রানি ভূবনময়ী দেবী নির্মাণ করেন।

এ মন্দিরের দোতলার একটি মাত্র কক্ষ এবং কক্ষের চারপাশে দুই স্তরে বারান্দা আছে। কক্ষটিতে আছে নক্সা খচিত কষ্টি পাথরের বিশাল শিব লিঙ্গ। মহারাণী ভুবণময়ী দেবী বিপুল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে এই শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের দুই স্তর বারান্দায় দেয়ালে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর চিত্র ছিল। মন্দিরটির উপরিঅংশে বিরাজ করতো ৫টি রতœ। তারমধ্যে বৃহৎ রত্নগাত্র অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোম্বুজ খোচিত এবং ৫টি রতেœর শীর্ষে ৫টি ত্রিশুল। যা অধিকাংশই এখন নষ্ট হয়ে গেছে।

এখানে আরও বলতে হয়, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২২ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর থাবা থেকে মুক্তি পায়নি এই শিব মন্দিরটি। মন্দিরের সমস্ত সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়। মন্দিরের দুইস্তর বারান্দার দেয়ালে চিত্রগুলো ধ্বংস করে। এবং মন্দিরের পঞ্চ রত্ন এবং ৫টি ত্রিশুল চুরি করে। তবে আমার মনে এখনও প্রশ্ন জাগে, কোটি টাকার কষ্টি পাথর দিয়ে তৈরী শিবলিঙ্গটি তারা কেন লুট করতে পারলো না? এই প্রশ্নটি তখন মাথায় আসেনি। পরে এসেছে।

শিবমন্দিরে সাপ থাকে না? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সাইট পরিচালক শ্রী বিশ্বনাথ দাস অনেকটাই আবেগী হয়ে পড়েন। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলতে খুব আবেগী হয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি হাতজড়ো করে বলছিলেন, হ্যাঁ- শিবের সাথে সাপ থাকে। তবে সেই সাপ দেখার সৌভাগ্য আমার মতো অভাগার হবে না।

এরপর আমরা যাই বড়ো আহ্নিক মন্দিরে। প্রতিটি স্থাপনা ছিল বাংলাদেশের ধর্মীয় একটি প্রাচীন নিদর্শন। একসময় হিন্দুরাই ছিল এই দেশের সবচাইতে ক্ষমতাধর সম্প্রদায়। আজকে বলতে গেলে তারা একদমই কোনঠাসা। এই কোনঠাসা শব্দটাও শ্রী বিশ্বনাথ দাসের পছন্দ হয়নি। তিনি আমাকে বললেন, ‘বাবা- এখানকার অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। এই যে আমরা কত শুনি- এই দেশে মানুষ হিন্দু ধর্ম পালন করতে পারে না। হিন্দুদের মারা হচ্ছে। ঠাকুরের দিব্যি কেটে বলি, আমি আজ পর্যন্ত এমন অনুভব করিনি। এখানকার মানুষ মন্দিরগুলোকে নিজের মায়ের মতো করে যত্ন করে রাখে। নইলে এই সব চুরি যেতো সেই কত আগে। এখনও সকলের কৃপায় প্রাচীন এই দৃশ্য বেঁচে আছে। `
 
পুঠিয়া রাজাদের এই সকল কীর্তি  চিহ্ন ও স্থাপত্য কর্মগুলির কবে নির্মিত হয়েছে এমন তথ্য সঠিকভাবে না পেলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পুঠিয়ায় অবস্থিত ১৬টি মন্দিরের মধ্যে একটি মন্দির বাদে বাকি ১৫টি মন্দিরিই নির্মিত হয়েছে ১৮১০-১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।

বর্তমানে পুঠিয়ায় ১৬টির মধ্যে ৯টি মন্দির পূর্ণ অবস্থায় আছে। ৪টি মন্দির ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এবং ২টি মন্দির সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
 
প্রায় দুইশত বছর ধরে এই মন্দিরগুলো কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক নিদর্শন বহন করছে এই মন্দিরগুলো। তবে মূল্যবান এই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ সরকার কতটা সফলভাবে করতে পারবে তা আমি জানি না। আমি যতটুকু বলতে পারি, ইতিহাস বহনকারী এই সৃষ্টিগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে সংস্কারের পাশাপাশি তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ সময় ১২৪৫, মার্চ ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।