ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

‘টমেটু পচিশ টেকা, বাজারে বত্তিরিশ কইর‌্যা..’

বিদিত চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৯ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১১
‘টমেটু পচিশ টেকা, বাজারে বত্তিরিশ কইর‌্যা..’

ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে ছেলেটি।   পুরো নাম মোহাম্মদ লিটন হাসান।

বয়স আঠারো।     

লিটন মিরপুর-১ এবং কাওরানবাজার থেকে সবজি কিনে আনে। যেদিন কাওরান বাজারে যায় সেদিন রাত বারোটায় ভ্যান চালিয়ে মিরপুর থেকে রওয়ানা দেয়। যেতে আধঘণ্টা, আসতে একঘণ্টার মতন  লেগে যায়। সেখানে কেনাকাটা চলে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। পাইকারি সবজি বাজার থেকে তরিতরকারি কিনে ফিরতে ফিরতে ছয়টা বেজে যায়।

-প্রতিদিন কত টাকার সবজি কিনেন?
-‘কাওরানবাজারে গেলে মনে করেন চার-পাঁচ হাজার টাকার সবজি কেনা হয়। এক নম্বর থিকা কিনলে পঁচিশশ’ টাকার মতন কিনি। ’
-লাভ থাকে কত ?
-‘প্রতিদিন পাঁচ-ছয়শ’ টাকার মতন লাভ থাকে। তবে লাভের কমবেশি হয়। কোনদিন একহাজারের মতনও লাভ হয় আবার কোন কোনদিন তিনশ’ টাকা লাভ হয়। যেদিন কোন সবজি আমার একার কাছে থাকে সেদিন এট্টু বেশি দামে বিক্রি করি। উপায় নাই । কাস্টমার বেশি থাকে। অন্যদিন একই দামে ছাইড়্যা দেই। যেমন, একবার টমেটো বিক্রি কইর‌্যা অনেক লাভ করছি । করলা শুরুতে ৮০ টাকা কইর‌্যা বেচছি। গতকাল ৬০ টাকায় বেচছি, আজকে ৪০ টাকায় বিক্রি করছি। সময় বুইঝ্যা ...। ’

-কত টাকা নিয়ে ব্যবসায় নামছিলেন?
-‘মূলধন ছিল দুই হাজার। শুরুতে পাঁচ হাজার টাকার একটা ভ্যান নিয়া নামছিলাম। ’
 
 এ পর্যন্ত ওর দুটো ভ্যান চুরি হয়েছে।
-কিভাবে হল?
-‘একটা বাজার থিকা চুরি হইছে। আরেকটা বাসার সামনে থিকা নিয়া গেছে। আরেকবার বাটখারা, টাকার বাক্স নিয়া গেছে। দুই হাজার টাকা ছিল বাক্সে। এরপর থিকা শার্টের পকেটে টাকা রাখি। এটা অসুবিধা। বারবার বাইর করতে গিয়া টাকা পইড়্যা যায়। ’

এখন ওর দুটো ভ্যান আছে। একটি নিজে চালায়। অন্যটিতে ছোট ভাইকে বসিয়ে দিয়েছে।
ভোর হতেই মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে  ভ্যানে করে চলে বেচাকেনা। নয়টার মধ্যেই সমস্ত সবজি ফুরিয়ে যায়।
 
বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে  থেকে পাশের গলিতে সরে  যেতে  হয়েছে। তবে এতে ওর ব্যবসায়ের তেমন ক্ষতি হয়নি।

-ব্যবসায়ের জন্য কাউকে টাকা দিতে হয়?
-‘না, শুধু এলাকা পরিষ্কার রাখার জন্য সুইপারকে প্রতিদিন পাঁচ টাকা দিতে হয়। ’

কাওরান বাজারে গেলে পরদিন বিক্রি শেষে বেলা এগারোটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত লিটন ঘুমায়। কথাবার্তায় খুব সপ্রতিভ লিটন। আমার সাথে গল্পে মেতে গেছে ঠিকই, পাশাপাশি ক্রেতাদের সাথে দরদামও করে যাচ্ছে। কোনো ক্লান্তি নেই ।
 
-বেগুন কেমন ? নষ্ট হইবো না তো?
‘খারাপ মাল বেচি না কাকা। খারাপ মাল রাখলে একদিন, দুইদিন, এরপর লোক কইব, তর জিনিস খারাপ। আরেক জায়গা থিকা নিব। লাভ এট্টু কম করি। তারপরও ভাল মাল রাখি। ’

সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। কথাপ্রসঙ্গে জানাল, অনেকেই তার বাঁধা কাস্টমার। যেকোন সবজি কিনতে হলেই সকালবেলা  মর্নিংওয়াকে এসে ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে  প্রথমে লিটনের খোঁজ করবে। দরদাম করারও প্রয়োজন বোধ করে না। চমক ভাঙল কালো বোরকা পরিহিতা মধ্যবয়েসী নারীর ডাকে, ‘দুই টাকা কম রাখ্ ক্ষাপ, তোর কাছে ত আমরার আবদার বেশি। ’  
 
মাঝেমধ্যে ব্যবসায়ে লোকসান হলেও ভেঙে পড়ে না ও। কিন্তু জীবনযুদ্ধে হার মানার সৈনিক লিটন নয়। দিনশেষে একটুখানি সুখের আশাও তাঁর মুখে হাসি ফোটায়। বেচাবিক্রি শেষের পথে। লিটন ওর পুঁটলিতে টাকাগুলো গুনে রাখছে। একটু পরেই রওয়ানা দেবে বাসার উদ্দেশ্যে। ওর চোখের তারায় যেন সবসময়ই একটা উজ্জ্বল দ্যুতি খেলা করছে।    
 
লিটন চলে যাচ্ছে । দেখতে দেখতে তার শরীরটা চোখের আড়াল হয়ে গেল।  

বাংলাদেশ সময় ১৫৩৭, মার্চ ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।