ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

নুটের জন্য শোকগাথা

রবাব রসাঁ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৭ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১১
নুটের জন্য শোকগাথা

‘নুট’ আর নেই। মাত্র চার বছর বয়সেই চলে গেল সে।

তুরস্কের একটি জাতীয় দৈনিকে খবরটি দেখে চোখ আটকে গেল। বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটেছে বার্লিনে, শনিবার সন্ধ্যায়।

প্রায় সাতশ দর্শকের সামনে নুট নুয়ে পড়ল মৃত্যুর কোলে। এ নিয়ে শোকাচ্ছন্ন বার্লিনসহ গোটা জার্মানি। খোদ বার্লিনের নগরপিতা বিবৃতি দিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন।

ব্রিটেনের ডেইলি মেইল লিখেছে ‘ম্যাসিভ হার্টঅ্যটাকে’ মারা গেছে নুট। তার অকালমৃত্যুর জন্য বার্লিনের চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছে পশু অধিকারবাদী সংস্থা পেটা (PETA)। বোঝাই যাচ্ছে অতলান্তিকের দু’পাড়ই বেশ সরগরম এই ‘সেলিব্রিটি’ মেরু ভালুকটিকে নিয়ে।

মেঘলা আকাশ। সকালে খানিকটা বৃষ্টিও হয়েছে। মার্চের এই দিনে বার্লিনে বৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। শীত কমছে, বৃষ্টি আসে বসন্তের বার্তা নিয়ে। খানিকটা বৃষ্টি গায়ে মেখে আমরা ক’জন মিলে ঘুরছিলাম বার্লিন চিড়িয়াখানায়। কতশত চিড়িয়া সেখানে। কিন্তু প্রধান আর্কষণ নিঃসন্দেহে নুট। গেল বছর বার্লিনে ঢুকেই বন্ধুদের কাছে প্রথম যাদের গল্প শুনেছিলাম, তাদের মধ্যে নুটের নামটাও ছিল। তাই তার মৃত্যুর খবরটি দেখে সেখানে চোখ আটকে গেল। স্মৃতিতে ভেসে উঠল তার নাদুস-নুদুস আদুরে চেহারা।

২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর বার্লিন জুলোজিক্যাল গার্ডেন বা বার্লিন চিড়িয়াখানায় জন্ম নিয়েছিল একটি মেরু ভালুক। ভাবতে দোষ নেই, আনন্দের জোয়ার এসেছিল শহরটিতে। কেননা, গত ত্রিশ বছরে বার্লিনে এটিই প্রথম জীবন্ত মেরু ভালুকশাবকের জন্ম। তবে একটা সমস্যা দেখা দিল। জন্মের পরই শাবকটির মা তাকে পরিত্যাগ করে। স্বাভাবিকভাবে শাবকের প্রতিপালনের দায়ভার পড়ে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের ওপর। চিড়িয়াখানার কিপার টোমান দুরফেইন হয়ে ওঠেন নুট নামের এই শাবকটির পালনকর্তা।

তারপর থেকে শুরু নুটের গল্প। সেই গল্প ছড়িয়ে যায় শহরের সীমা ছাড়িয়ে দেশ, দেশের সীমা ছাড়িয়ে নানা মহাদেশে। অতলান্তিকের পশ্চিমপাড়েও ছড়িয়ে যায় নুটের নাম। তাকে নিয়ে ‘ফ্যান কাব’ গড়ে ওঠে দেশে দেশে। গণমাধ্যমে শুরু হয় প্রচারণা। বই, ডিভিডি, খেলনা, ডাকটিকিট, চাবির রিং, কী নেই নুটকে নিয়ে! ২০০৭ সালে ভ্যানিটি ফেয়ারের প্রচ্ছদ হয়েছিল সে। সৃষ্টি হয় ‘নুটম্যানিয়া’ নামের এক পরিভাষাও।

knutভরদুপুরে নুটের বাড়ি পৌঁছার আগেই শুনতে পেলাম শোরগোল। দূরে বাচ্চা-বুড়ো সবার মুখে নুটের ‘জয়ধ্বনি’। চিড়িয়াখানায় আমরা তখন ছিলাম ‘সীলমাছের বাড়িতে’। ‘নুট’ শব্দটি কানে আসতেই দেখলাম কিছু দর্শক দৌঁড়ালেন সেদিকে। আমাদের দলের ভেতরেও আওয়াজ উঠল ‘দে দৌড়!’

সাধারণত, উন্মুক্ত প্রকৃতিতে একটি মেরু ভালুক বাঁচে ১৫ থেকে ২০ বছর। আর চিড়িয়াখানায় বাঁচে আরো বেশি দিন। কেননা, সেখানে তাদের তো আর ক্ষুধা, রোগের কষ্ট ভোগ করতে হয় না। তাই নুটের অকালমৃত্যু শুধু শোক নয়, সৃষ্টি করেছে ক্ষোভও। পেটা বলেছে, ‘নুটকে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষকে আমরা আগেই বলেছিলাম। আমাদের কথা শুনলে তার অকালমৃত্যু এড়ানো যেত। ’ নুটের সঙ্গী-সাথী ভালুকেরা নাকি বেশ ত্যক্ত- বিরক্ত করত তাকে।

অনেক লোকের এক জটলার সামনে এসে দেখি, সাদা পোশমের কম্বল গায়ে দিয়ে মাঝারি গোছের একটি ভালুক ‘গুহামুখে’ বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। সারি বেঁধে শোরগোল ‘নুট’, ‘নুট’। সবাইকেই দেখলাম খানিক উৎকণ্ঠা নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অপেক্ষা করছেন ‘কখন আসবেন তিনি’। নিজের প্রয়োজনেই কিনা জানি না, শোয়া থেকে উঠে ধীর পায়ে ‘তিনি’ এগিয়ে এলেন একটু সামনের দিকে। আর অমনি আওয়াজ উঠল তার নাম ধরে। আরো দর্শক ছুটে এলেন।

নুটের জনপ্রিয়তা জার্মানিতে এতটাই ছিল যে, তাকে দেখিয়ে বার্লিনের চিড়িয়াখানা আয় করেছে কয়েক লাখ ইউরো। ২০০৭ সালে নুটকে ট্রেডমার্ক করে নেয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ফলে পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। সেই সালেই এটি এর ১৬৩ বছরের ইতিহাসে জার্মানির সবচেয়ে দামি প্রতিষ্ঠান হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

নুটকে দেখে আমরাও খুব গর্বিত হলাম। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে জার্মান বন্ধু আঙ্কে বলল, ‘তোমরা খুবই ভাগ্যবান। অনেকেই অনেক দূর থেকে অনেক খরচ করে এসেও নুটের দেখা পায় না। শুনেছি আজকাল সে আর গুহার বাইরে খুব একটা পা বাড়ায় না। ’

নুটের এই অকালমৃত্যু বার্লিনবাসীর মতো আমাকেও ছুঁয়ে গেছে : ‘নুট ভির ডিশ নোশ্ লিয়েবে -- নুট আমরা এখনো তোমাকে ভালোবাসি!’

বাংলাদেশ সময় ১৯১৫, মার্চ ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।