ঢাকা, রবিবার, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বেদেদের নতুন জীবন

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪
বেদেদের নতুন জীবন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাভার: ‘হিংসে করিস না, দশটা টাকা দিয়ে যা’ -হঠাৎ পথ আগলে এ ধরনের আবদার হর-হামেশাই চোখে পড়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে।

কাঠের তৈরি ছোট্ট বাক্স অথবা অ্যালুমনিয়ামের গোল কৌটা এগিয়ে দিয়ে এই আবদার জানানো মানুষগুলো ভিক্ষুক নন।

তারা নিজেদের ঐতিহ্যগত পেশা ছেড়ে নতুন করে ভিক্ষাবৃত্তিতে আসা বেদে নারী।

জীবন ও জীবিকার তাগিদে শত বছরের পুরোনো পেশা ছেড়ে এসব বেদে নারী কেন ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন তা জানা গেছে সাভারের বেদেপাড়া ছোট অমরপুর, বড় অমরপুর, পোড়াবাড়ি, বক্তারপুর ও জয়পাড়া এলাকায় গিয়ে।

স্বতন্ত্র জীবনাচার ও নিজস্ব ঐতিহ্যের অধিকারী বেদে সম্প্রদায় এখন অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু।   সময়ের প্রয়োজনে তাই পাল্টে যাচ্ছে জীবিকার ধরন, এমনকি জীবনবোধও।

পরিবর্তিত সামাজিক বাস্তবতায় কেমন আছেন তারা?

জানা গেছে, আদিকাল থেকে বেদে নারীরা চুড়ি-ফিতা-খেলনা বিক্রি, শিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা, তাবিজ-কবজ বিক্রি, সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসা, সাপের খেলা দেখানো, সাপের ব্যবসা করা, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য সেবাদান, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, মৃত পশুর শরীরের অংশ এবং গাছ-গাছড়ার ওষুধ তৈরি করে বিক্রি, বানরখেলা ও জাদু দেখানো, মাছ ধরা, পাখি শিকার ইত্যাদি হরেক উপায়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিš‘ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি, আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে বেদে নারীদের এসব সেবা গ্রহণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাই জীবনের তাগিদে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পেশা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছেন বেদে সম্প্রদায়ের নারীরা।

বিকল্প পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন স্থানীয় বাজারে দোকান করা, হাঁস-মুরগি বা কবুতর পালন, মাছ চাষ ও কাঁথা-কাপড় সেলাইয়ের মতো গের¯’ঘরের কাজ। কেউ কেউ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য সাপ ভাড়া এবং ক্ষেত্র বিশেষ চলাচিত্র শিল্পে পার্শ¦ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও পাচ্ছেন।

ছেলেদের এই প্রজন্মের বেশিরভাগই লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। তারা ভালো করে সাপ ধরা বা খেলা দেখানো এসব কোনো কিছুই জানেন না। ঘুরে ঘুরে খেলা দেখানোর পেশা ছেড়ে তারাও ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

সাভারের পোড়াবাড়ি রাস্তার পাশে চায়ের দোকান দিয়ে বসা বেদেকন্যা শিউলী আক্তার বলেন, ‘আমার মা-খালারা গ্রামে গ্রামে গাওয়াল করে সিঙ্গা লাগিয়ে, দাঁতের পোকা তুলে, তাবিজ-কবজ বিক্রি করে সংসারের খরচ জোগাতেন।

আমিও এক সময় ওই কাম করছি। এখন চা বিক্রি করি। আগের চেয়ে ভালোই আছি’।

মা-খালার পেশা ছাড়লেন কেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে শিউলী বলেন, ‘এহন আর মানুষ তাবিজ-কবজ কিনতে চায় না’।

কিš‘ শিউলীর মতো দোকান করার জায়গা বা পুঁজি কোনোটিই যাদের নেই। নেই নিজস্ব ঘর-দুয়ার-মাথা গোজার ঠাঁই অথবা নৌকা-বৈঠা, সেসব বেদে নারী ঢাকা শহরের পার্ক-উদ্যান, বাস স্টপেজ, বিনোদন কেন্দ্র বা ব্যস্ততম এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি চর্চা করছেন। কেউ কেউ পা বাড়াচ্ছেন পঙ্কিল পথে।

তাছাড়া বিনোদনের নতুন নতুন ব্যবস্থার প্রচলন হওয়ায় সাপ খেলা দেখে আগের মতো এখন আর আনন্দ পান না মানুষ। বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় সাপও পাওয়া যায় না। তাই বেদেদের ঐতিহ্যগত পেশায় ধস নেমেছে। এতোদিনকার সংস্কার-বিশ্বাসে আঘাত এসেছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্র¯’ হচ্ছেন বেদে নারীরা।

সাভারের পোড়াবাড়ির বেদে যুবক মো. রঞ্জিত হোসেন বলেন, আমাদের মধ্যে যারা খুবই গরীব, যাদের কোনো ঘর-বাড়ি নেই, নৌকা ও পুঁজি-পাট্টা কিছুই নেই, ঝুপড়িতে থাকেন, সেসব ঘরের মেয়েরা সকালে উঠে সাভারের আশ পাশের এলাকায় যান। মানুষের কাছে হাত পেতে অথবা সাপ দিয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা-পয়সা ওঠান। তবে যাদের জায়গা-জমি বা দোকান আছে তারা কখনো যান না।

বেদে বলতেই পৃথিবীর রহস্যময় একদল মানুষের চেহারা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যাদের বড় বড় চুল, অস্বাভাবিক লম্বা গোঁফ, কাঁধে গেরুয়া কাপড়ের ঝোলা, হাতে বীণ, মাথায় সাপের ঝাঁপি। যাদের বেঁচে থাকার জন্য রয়েছে বিচিত্রসব পেশা। তন্ত্র-মন্ত্র, যাদু-টোনা ও বশিকরণ বিদ্যায় যাদের আজন্ম লালিত বিশ্বাস।

কিš‘ সমাজ জীবনের মৌলিক পরিবর্তনের ধারায় আলাদা বৈচিত্রের ধারক-বাহক বেদে সমাজের বিশ্বাস ও সংস্কারে ফাটল ধরেছে। তন্ত্র-মন্ত্র, জাদু-টোনা, শোক-সঙ্গীত উ”চারণ ও অদ্ভুত পোশাক থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছেন আদি নৃ-গোষ্ঠীর এই মানুষগুলো। তাদের পোশাক, ভাষা, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান থেকে দিন দিন উধাও হয়ে যাচ্ছে পূর্বপুরুষের শত বছরের পুরোনো সংস্কৃতি। সাপ-সাপুড়ে, সাপের ওঝা, ঝাড়ফুঁক কোনো কিছুতেই আর বিশ্বাস নেই বেদে সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের।

তারা কেবল ভবঘুরে যাযাবর জীবনই পেছনে ফেলে আসেননি, জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন পূর্বপুরুষের সংস্কার ও বিশ্বাস। যে যাযাবর মানবগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের জল-বিল ও নদীবহুল অঞ্চলে দেখা যেতো, যাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী-পুরুষ নানা রকম ঝড়িবুটি, টোটকা চিকিৎসায় জড়িত ছিলেন বলে তাদের নাম হয়েছিল বেদে বা বাইদা, সেই তারাই আজ এসবের ওপর থেকে হারিয়েছেন বিশ্বাস।

লাউয়ো, চাপাইলা, বাজিকর, বেজ, গাইন, মেল”ছ, বান্দাইরা, মাল ও সাপুড়িয়া-আমাদের সমাজের এই ৯ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে মূলত বেদে সম্প্রদায় গঠিত।

তাদের মধ্যে সাপুড়ে বা সাপুড়িয়া জনগোষ্ঠীর মূল কাজ ছিল সাপ ধরা, সাপের বিষ নামানো, সাপের খেলা দেখানো, কড়ি চালান দিয়ে বা বীণ বাজিয়ে সাপ আনা, সাপে কাটা মানুষকে তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা। আর এসব কিছুই নির্ভর করতো বিশ্বাস বা সংস্কারের ওপর। যেখানে ছিল না বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি বা যুক্তি। কিš‘ হালে এসে বেদে সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম পূর্বপুরুষের চিরকালীন বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে বের হয়ে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও যুক্তিকেই গ্রহণ করতে শুরু করেছেন।

সাভার পৌর এলাকায় যে কয়েকটি বেদেপল্লী আছে তাদের প্রত্যেক গ্রামে একটি করে মসজিদ আছে। বেদেপল্লীর কবরস্থান আছে ১টি। যা আবার এলাকাবাসী ব্যবহার করায় বেদে সদস্যদের কবর দিতে সমস্যায় পড়তে হয়।

এ ব্যাপারে ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের এই বেদেপল্লীতে কবরস্থান ছাড়া তেমন আর কোনো সমস্যা নাই। বেদেপল্লীর চারপাশে সরকারি অনেক খাসজমি আছে এগুলো যাতে তাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় সেজন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আর্কষণ করেন।

বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েদের ক্ষমতা অপরিসীম হলেও একটি বহরে সর্দার হন একজন বেদে পুরুষ। অভ্যন্তরীণ যেকোনো সমস্যার সমাধান সরদাররাই করে থাকেন। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বাস, সংস্কার, পেশা, খাদ্যাভ্যাস, রীতি-রেওয়াজ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, কৃষ্টি-কালচারে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও  বেদে সমাজে পুরুষদের কর্তৃত্ব এখনো অটুট। সব প্রথা বিলীন হয়ে গেলেও বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই প্রথা ভাঙতে পারেনি বেদে সমাজ।

বেদে সম্প্রদায়ের কিছু পুরুষ সাপ খেলা দেখানো, সাপ ধরা ও কবিরাজি পেশায় যুক্ত থাকলেও মূলত মেয়েরাই শহর-বন্দর-গ্রামে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিরক্ষর ও দরিদ্র মানুষের দাঁতের পোকা খসিয়ে, ঝাড়ফুঁক দিয়ে, সিঙ্গা লাগিয়ে যা আয় করেন তা দিয়েই চলে সংসার।

তবে আয়-উপার্জনের দায়িত্ব বেদে নারীর ওপর ন্যস্ত থাকলেও খরচের এখতিয়ার থাকে বেদে পুরুষের কব্জায়। প্রতিদিনের উপার্জিত অর্থ পুরুষের হাতেই জমা রাখতে হয় তাদের। নারীদের তুলনায় বেদে পুরুষরা কিছুটা অলস হয়। কায়িক পরিশ্রমকে তারা ঘৃণা করে। ফলে সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য বেদে মেয়েদেরই বাইরে বের হতে হয়। তেমন কোনো কাজ নেই। বা”চা-কা”চা যাদের আছে তারা বা”চা-কা”চা নিয়ে থাকেন। বাকিরা কবিরাজি ওষুধপত্র বানান।
আর যারা সাপ খেলা দেখান তারা সাপের সেবা-যত করেন।

দিনে তিন থেকে চার বার সাপের খাবার দেওয়া লাগে। যদিও সাপের বিষদাঁত ভাঙা থাকে, তারপরও এ কাজ সাধারণত বয়স্ক পুরুষরা করে থাকেন। শিশু ও নারীদের দিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হয় না।

বেদেপল্লীর সরদার মো. ইউসুফ হোসেন বলেন, আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে আমাদের আদি বসবাস ছিল মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এলাকায়। সেখান থেকে অনেকে যখন সাভারে এখানে বসবাস করার জন্য বাড়ি-ঘর তুলছিলেন, তখন মাটির নিচ থেকে পোড়া হাড়ি, বালতি ও কলসের ভাঙ্গা পাওয়া অংশ যায়। তখন থেকেই এর নাম প্রচলন হয়ে আসছে পুড়াবাড়ি।

তিনি জানান, ডেরা, ভাসমান বহর বা স্থায়ী পল্লীতে পুরুষরাই সরদার হন। কেউ কোনো অপরাধ করলে সর্দার তার বিচার করেন। এক্ষেত্রে সর্দারের কাছে দু'পক্ষেরই টাকা জমা রাখতে হয়। যে পক্ষ বিচারে হেরে যায়-সর্দার তার টাকা দিয়ে বহরের লোকজনকে খাইয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ সময়: ০১০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।