ঢাকা, রবিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩২, ০৪ মে ২০২৫, ০৬ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ও পাখি তোর যন্ত্রণা...

রহমান মাসুদ ও ইনজামামুল হক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:১৫, আগস্ট ১৮, ২০১৪
ও পাখি তোর যন্ত্রণা... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাগেরহাট: ও পাখি তোর যন্ত্রণা, আর তো প্রাণে সয় না, যখন তখন তোর জ্বালাতন ভালো লাগে না... বাংলা চলচ্চিত্রের এই মিষ্টি রোমান্টিক গানে যন্ত্রণা ছিল মধুর এক ভালো লাগার। মধুর এমন যন্ত্রণা হয়তো সবারই কাম্য।



কিন্তু বাগেরহাট শহরবাসী সত্যি সত্যিই কাতর হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার পাখির প্রকৃত যন্ত্রণায়। শহরের ডাকবাংলো মোড়, শিল্পকলা একাডেমি, ডিসি বাংলো, কোট মসজিদ, পুরাতন আদালত (কোর্ট) এবং সাংস্কৃতি ফাউন্ডেশন চত্বর যেনো পাখিদের স্বঘোষিত অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে।

এ এলাকার গাছের নিচ দিয়ে তো বটেই রাস্তা দিয়েও শান্তিতে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। ওপর থেকে টুপটাপ করে পড়তে থাকে পাখির বিষ্ঠা। গাড়িগুলোর রং পরিবর্তন হয়ে যায় নিমিষেই। কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও ওই পথ বা স্থাপনা মাড়াতে চান না কেউ। এমনকী একসময় মানুষের ব্যবহারযোগ্য পুকুরের পানিও পাখির বিষ্ঠায় পচে একাকার।

তবে জ্বালতন যতোই হোক  না কেন, পাখি ভালো লাগে না এ শহরে এমন মানুষের সংখ্যা হয়তো শূন্যেরই কোঠায়।

পাখির আবাসস্থলের সংকট, চোরা শিকারিদের উৎপাত, অনুকূল আবহাওয়া, খাদ্য সংকট, মানুষের আন্তরিকতার অভাবসহ নানা কারণে দিন দিন কমছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সংখ্যা। এমন সব প্রতিকূলতার মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই যেনো বাগেরহাট শহরের এ অঞ্চলকে বেছে নিয়েছে তাদের অভায়াশ্রম হিসেবে। মূলত নিরাপদ ভেবেই গত প্রায় ২৪-২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ এলাকায় অবস্থান নিয়েছে কয়েক হাজার সাদা বক, কাল কুঁচ ও পানকৌড়ি পাখি। এখানে থাকা কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি, বট, আম, নিম, নারকেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছে বসবাস এসব পাখির।

স্থানীয়দের ভাষায়, চারদিকে প্রশাসনিক নিরাপত্তার কারণে এক প্রকার নির্ভয়েই থাকে পাখিগুলো। তবে পাখির এ নির্ভাবনা এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ এলাকা দিয়ে চলাচলকারী পথচারী ও যানবাহনের জন্য। কেননা সড়কের দুই ধার দিয়ে যে গাছ, এতো কোলাহল সত্বেও সেসব গাছে শতাধিক পাখির বাস। তাদের মল বা বিষ্ঠায় বিপাকে এখনকার পথচারীরা। তাই পাখি ভালোবাসলেও পাখিদের এ জ্বালাতন থেকে  মুক্তি চায় এ এলাকার মানুষ।

বাগেরহাটের আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নব্বই এর দশকের ছাত্র আরিফ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ছোট বেলা থেকেই এখানে পাখি দেখে আসছি। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন এমন কোনো দিন ছিল না , যেদিন কেউ এই পাখির বিষ্ঠায় নিজেদের জামা-কাপড় নোংরা না করেছেন। এ যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে আমরা দৌঁড়ে এ এলাকা পার হতাম।

বাগেরহাটের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মকর্তা সুব্রত কুমার মুখার্জি বাংলানিউজকে জানান, খাবার সংগ্রহের জন্য পাখিগুলো দূর-দূরন্তে গেলেও দিনের শেষে তারা আবার ফিরে আসে এখানেই। এখানেই বংশ বিস্তার করে এসব পাখি।

শহরের ব্যস্ততম সড়কের পাশেই পাখিদের এমন আবাসের কারণে জন সাধারণের কিছুটা দুর্ভোগ হলেও পাখিদের নিরাপদ অভয়াশ্রম হিসাবে এ চত্বরটি রক্ষার দাবি জানান তিনি।

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ দিন ধরেই এই চত্বরে পাখিদের বসবাস। এক সময় ডিসির বাংলো (জেলা প্রশাসকের বাসভবন) এবং পুরাতন কোর্ট চত্বরেই ছিল পাখিদের মূল আশ্রয়। তবে প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় এখানকার গাছগুলোর ডাল কেটে ফেলার কারণে পাখির এ নিরাপদ আবাসস্থল হুমকিতে পড়েছে।

তারা জানান, সিডরের পর ২০০৭ সালের শেষের দিকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) শহিদুল ইসলাম পাখিগুলোর কারণে জন সাধারণের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে অজুহাতে ব্যাপকভাবে এখানকার গাছগুলোর ডাল কেটে ফেলার উদ্যোগ নেন। সেসময় এখান থেকে অনেক পাখি চলে যায়। ফলে কমে যায় পাখির সংখ্যা। এর পরও বিভিন্ন সময় এখানকার গাছের ডাল কাটার কারণে পাখিরা তাদের আবাসস্থাল নিয়ে অস্তিত্বের সঙ্কটে রয়েছে।

পাখি ভালোবাসলেও এবং পরিবেশ রক্ষায় পাখিদের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার না কররেও অনেকেই পাখিদের এ আনাগোনা ‌এখন আর ঠিক উদার দৃষ্টিতে দেখছেন না।

এমনই একজন পান দোকানী গোপাল দাস। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, পাখির যন্ত্রণায় এখানে ব্যবসা করা তো দূরের কথা, এ পথ দিয়ে চলাচল করাই দায়।

তাই পাখিগুলোকে এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে বা উড়িয়ে দেবার দাবি তার।

তবে স্থানীয় প্রবীণ ও সচেতন মহল মনে করেন, পাখিগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায এখনই উদ্যোগী হওয়া দরকার। তাদের মতে বিভিন্ন সময় এ চত্বরের গাছের ডালপালা কেটে পাখিদের আশ্রয়স্থল নষ্ট করা হচ্ছে। এটা বন্ধ করা দরকার।

শহরের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোজাফফর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এমনটা সাধারণত দেখা যায় না যে শহররের মাঝেই পাখিদের এমন আশ্রয়স্থল। এটা সৌভাগ্যেরই বটে।
bird_01
তাই পাখি এবং এদের আশ্রয়স্থল সংরক্ষণে সবার আন্তরিকতা ও উদ্যোগী হবার তাগিত দেন তিনি।

এ ব্যাপারে বাগেরহাটের প্রবীন শিক্ষক প্রফেসর বুলবুল কবির বাংলানিউজকে বলেন, পাখিগুলোকে রক্ষায় তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণের বিকল্প নেই। বিভিন্ন সময় কিছু গাছের ডাল কেটে ফেলা এবং পুরনো কিছু গাছ মারা যাওয়ায় বর্তমানে তাদের আবাসস্থানের সংকট তৈরি হয়েছে।

তাই দ্রুত এ অঞ্চলে আরো গাছ লাগাবার তাগিত তার।

তার মতে, সড়কের পাশে পাখির কারণে যেহেতু জনসাধারণের কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় এজন্য এখানকার ফাঁকা এলকাগুলোতে অধিক গাছ লাগানো দরকার। এতে জনসাধারণের চলাচলের দুর্ভোগও অনেকটা দূর হবে।
bird_02
বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সভাপতি বাবুল সরদার বাংলানিউজকে বলেন, পাখিগুলোর জন্য মাটির কলসি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বাসা তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে। এতে বিষ্ঠার করণে দুর্ভোগ লাঘোব হওয়া হয়তো সম্ভব।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মু. শুকুর আলীর সঙ্গে।

বাংলানিউজকে তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে পাখিগুলো এই চত্বরে বসবাস করছে। এখানেই তারা বংশবিস্তারের নিরাপদ স্থান মনে করে। ফরে কখনোই তারা এ চত্বর ছেড়ে যেতে চায় না।

অনেক সময় মানুষের যাতায়েতে সমস্যা হলেও পাখি রক্ষায় সবাইকে সহনশীল হতে হবে বলে অভিমত তার।

এ চত্বরের পুরাতন কোর্ট এলাকার ফাঁকা স্থানগুলোতে নতুন করে গাছ লাগিয়ে পাখিদের আবাসস্থল নিশ্চিত করা সম্ভব কিনা জনতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বিষয়টি তারাও ভাবছেন। ওই স্থানটি জজ কোর্টের। আমরা তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।

তিনি বলেন, রাস্তার উপরে পাখিগুলো আসলে কিছুটা সমস্যা হয়। তবে এ এলাকারই একটু ভেতরের দিকে গাছ লাগিয়ে যদি পাখিগুলোর আবাসস্থাল তৈরি কারা যায় তবে অনেক দুর্ভোগ লাঘব হবে।

এব্যপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।