ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

সাইকেলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সফর

‘এই বিচ্ছেদের অবসান হোক’

রবাব রসাঁ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১১
‘এই বিচ্ছেদের অবসান হোক’

‘মানচিত্র, সীমারেখা- একবিশ্বে বিভক্ত পৃথিবী/ কবি তার অংশ নয়-/তার নাম চিরমুক্ত পাখি/জন্ম যদি চুরুলিয়া মৃত্যু তবে ঢাকার মাটিতে/কবিকে রুখতে পারে এরকম কাঁটাতার নেই। ’

জয়নাথ নন্দীকে বহনকারী সাইকেলের সামনের ক্যারিয়ারে রাখা প্লেকার্ডে ছাপানো রয়েছে এই কবিতাংশটি।

গায়ের টি-শার্টটির বুকের মাঝখানে নজরুলের প্রতিচ্ছবি। এর একপাশে ছোট করে চিরঞ্জীব সাহিত্যপত্র ও অপরপাশে কোল্ডফিল্ড নেচার লাভারস-এর লোগো। তার সাইকেলটির হাতলের কাছে আঁটো করে বাঁধা আছে বাংলাদেশ ও ভারতের ছোট ছোট দুটি পতাকা। টি-শার্টের পেছনে লেখা রয়েছে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সফর, কবিতীর্থ চুরুলিয়া-ঢাকা। ’

এ দিকে জয়নাথের সহযাত্রী দেবাশীষ ভট্টাচার্যের টি-শার্টের পেছনে লেখা রয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি। ’ বুকের মাঝে নজরুল। তার দুই পাশে দুটি ছোট লোগো, যেমনটি রয়েছে জয়নাথের টি-শার্টে। তার সাইকেলের সামনের ক্যারিয়ারে রাখা প্লেকার্ডে ছাপানো রয়েছে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সফর, কবিতীর্থ চুরুলিয়া-ঢাকা’।

তাদের দূর থেকে দেখলেও সহজেই বোঝা যায় তারা কোনো বিশেষ ভাবনা নিয়ে পথে নেমেছেন। তারা কোনো বিশেষ ভাবনা তুলে ধরতে চান জনগণের মাঝে। তাদের বিশেষ কিছু বলার আছে। সাইকেল আরোহী এই দুজনের সঙ্গে পরিচয় হলো খন্দকার আহম্মদ আলীর মাধ্যমে। আলীর খ্যাতি ‘সাইকেল পরিব্রাজক’ হিসেবে। দেশের সবকটি জেলাই তিনি ঘুরেছেন সাইকেল চালিয়ে। এবার লক্ষ্য সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ।

চেহারায় বিদেশির ভাব নেই। যদিও জয়নাথ ও দেবাশীষ দুজনেই ভারতীয়। তবে নিজেদের পশ্চিমবাংলার বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করেন। বিশেষ করে বলতে ভালোবাসেন, ‘কবি নজরুলের বাড়ি চুরুলিয়ায় আমাদের বাড়ি’।

জয়নাথ পেশায় দলিল লেখক। অফিস বর্ধমান জেলার রাণীগঞ্জে। পেশা যা-ই হোক, তার নেশা কিন্তু পাহাড় টপকানো। দিগন্ত-রেখায় ঝাড়খণ্ডের পাহাড়চূড়াগুলো তাকে টেনেছে আশৈশব। তিনি পরিবেশবাদী ও পর্বতারোহী সংগঠন ‘কোল্ডফিল্ড নেচার লাভারস’-এর যুগ্ম সম্পাদক। অন্যদিকে, দেবাশীষও দলিল লেখক। চাকরি করেন একই অফিসে। তবে তার নেশা কবিতায়, সাহিত্যে। তিনি ‘চিরঞ্জীব’ নামের একটি ছোট কাগজের সম্পাদক। তাই বাংলাভাষার সব কবিই আর আত্মীয়।

‘ছোটবেলায় নজরুলের ‘লিচুচোর’ আবৃত্তি করে প্রথম হয়েছিলাম। কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। আমিও সেই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমাদের চেতনায়, আদর্শে নজরুল ও নজরুলের কবিতা,’ কথা শুরু করলেন জয়নাথ। দেবাশীষ তুলে ধরলেন নজরুলের কবিতায় মানবতার বাণী।

এদের দুজনের পরিচয় দীর্ঘদিনের হলেও ঘনিষ্ঠতা বছর পাঁচেক আগে। ঘনিষ্ঠতার বিষয় ছিল বাংলাদেশ ভ্রমণ নিয়ে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাস-ট্রেন যা-ই হোক না কেন আসবেন বাংলাদেশ ভ্রমণে। দেখবেন নজরুলের সমাধিক্ষেত্র। দেখবেন ভাষা-শহীদের স্মৃতিসৌধ শহীদ মিনার। ‘এতদিন কল্পনায় ঘুরেছি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। এখন ঘুরতে চাই সশরীরে,’ চোখে-মুখে আলোর ঝিলিক ছড়িয়ে বললেন দেবাশীষ।

‘অবশেষে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আমাদের মাউন্টটেইনারিং কাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে বিষয়টি আবার প্রাণ পায়। এবার প্রকৃত অর্থেই শুরু হয় বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রস্তুতি,’ বললেন জয়নাথ। সাথে যোগ করলেন দেবাশীষ, ‘সাইকেলে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও পরে পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে সার্বিক সহযোগিতা পাই। ’

অল্পসময়ে অনেক তড়িঘড়ি ও অনিশ্চয়তার ভেতর পাসপোর্ট-ভিসা তৈরি করে, গ্রামের লোকজনদের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে জয়নাথ ও দেবাশীষ ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় কবিতীর্থ চুরুলিয়া থেকে রওনা হোন ঢাকার উদ্দেশ্যে। পরদিন রাতে পৌঁছান ভারতের সীমান্ত শহর বনগাঁয়। ‘এই মৈত্রী সফরের ‘টেকনিক্যাল পার্ট’টা দেখছি আমি আর ‘ইমোশনাল পার্ট’টা দেখছে দেবাশীষ। ’

সফরকারী এ দুই সাইকেল চালক বাংলাদেশের সীমান্ত শহর বেনাপোলে প্রবেশ করেন ১৮ ফেব্রুয়ারি। ‘অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। যাদের দিকে হাত বাড়িয়েছি, তারা বুকে জড়িয়ে ধরেছে। রাত গভীরে সাইকেল চালিয়েছি, এতটুকুও অসুবিধে হয়নি। একটি বারও মনে হয়নি বিদেশের মাটিতে আছি,’ একটানা কথাগুলো বললেন দেবাশীষ। এর সাথে যোগ করলেন জয়নাথ, ‘ভালোবাসার জয় পেয়েছি। যদি বাংলাদেশে না আসতাম তাহলে বুঝতেই পারতাম না এ দেশের মানুষ আমাদের কত আপন করে বরণ করে নিতে পারে। ’

জয়নাথের মন্তব্য, ‘রাজনীতি দেশভাগ করেছে কিন্তু বাঙালির হৃদয় ভাগ করতে পারেনি। ’

সফরকারীরা এই বাণী নিয়ে এসেছেন যে, আমরা শিল্প-সাহিত্য-খেলাধূলার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারি। সাধারণ মানুষের ভেতর এই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যম অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকায় আসর পর থেকেই বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জয়নাথ ও দেবাশীষ। এরই মধ্যে গিয়েছিলেন একুশের বইমেলায়, নজরুলের মাজার, শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও বিভিন্ন স্থানে। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে মানুষের ঢল দেখে বিস্মিত হয়েছেন। আনন্দে নেচেছেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ে। ‘প্রতিদিনই নতুন নতুন বন্ধু পাচ্ছি। আমরা বিদেশে আছি বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশ বাংলাভাষীদের জন্য মোটেও বিদেশ নয়,’ একই কথা বললেন দুজনেই।

তারা জানালেন, চুরুলিয়ায় নজরুলের নামে একাডেমি আছে, আছে বিদ্যালয় ও সংগ্রহশালা। প্রতি বছর আয়োজন করা হয় নজরুল মেলা, সাহিত্যালোচনা। ‘তবে যেহেতু নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি, তাই যদি এ দেশের সরকার কবির জন্মভূমির মানুষদের জন্য নজরুল সংক্রান্ত কিছু একটা করেন তাহলে মৈত্রীর বন্ধন যেমন আরো দৃঢ় হবে, তেমনি নজরুলকে আমরা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব,’ এমন করেই জয়নাথ বাংলানিউজের মাধ্যমে অনুরোধ পাঠালেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে।

দেবাশীষ বললেন, ‘আমাদের সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন কবি একটি দেশের জাতীয় কবি এজন্য আমরা বেশ গর্বিত। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের সম্মানিত করেছেন। তাই বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন, এই কবির জন্মভূমির দিকেও একটু তাকান। ’

জয়নাথ ও দেবাশীষ এ দেশের অতিথি। তবে খালি হাতে আসেননি এই অতিথিরা। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কবিপত্নী প্রমীলা কাজীর সমাধির মাটি। ‘কবি ও কবিপত্নী শুয়ে আছেন দুই জায়গায়। মাঝখানে অনেক দূরত্ব। আমরা কবিপত্নীর সমাধির মাটি ছড়িয়ে দিতে চাই কবির সমাধিতে। এমনিভাবে আমরা কবির সমাধির মাটি নিয়ে চুরুলিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চাই কবিপত্নীর সমাধিতে। আমরা চাই, এই বিচ্ছেদের অবসান হোক। ’

২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় কবির মাজার প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হবে এই অনুষ্ঠানের।

বাংলাদেশ সময় ১৪৪০, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।