রায়েন্দা, শরণখোলা, বাগেরহাট থেকে: ঘরে এক হাটু জল। বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই।
উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের সর্বদক্ষিণের উপজেলা শরণখোলা।
উপজেলার কেন্দ্রবিন্দু রায়েন্দা বাজারের নিকটে কদমতলা এলাকায় বাঁধের বাইরে বলেশ্বর নদীর তীরে থাকা মানুষের জীবনে এই দুর্ভোগ যেন নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোয়ারের জলে ভাসা বহু মানুষের জীবন এভাবেই বয়ে চলে। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিনের আমাবশ্যার জো এদের জীবনে নিয়ে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জোয়ারের জল দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের জীবনটাই বদলে দিয়েছে। বাড়ি ঘরের গা ঘেসে একটা ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তার শেষ চিহ্ন দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে হাঁটাচলা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোয়ারের পানি বাড়লে এ রাস্তা ডুবে যায়। প্রতিনিয়ত প্রতিকূলে থাকা জীবনের গল্পগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
গণমাধ্যমে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া নাগরিক সুবিধার সিকি অংশও এখানে বাস্তবায়িত হয় কিনা সন্দেহ। একজন তো নিজের কষ্টের কথা জানাতে গিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন,‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি জানেন আমরা এখানে কিভাবে বেঁচে আছি?’

বলেশ্বর নদীর এই তীরের বাসিন্দা রতন হাওলাদার। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে চারবার বড় ধরণের বিপদের মুখে পড়েছেন। একবার ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের ট্রলার চলে গিয়েছিলো ভারতের কোনো এক এলাকায়। প্রায় দু'মাস পর বাড়ি ফিরেছেন। আরেকবার ঝড়ের ঝাপটায় ট্রলার নিয়ে গিয়েছিলো বনের ভেতরে। বেশ কয়েকদিন সেখানে থেকে কাঁচা মাছও খেতে হয়েছে তাকে। আরেকবার জলদস্যুর আস্তানায় আটকা পড়েছিলেন প্রায় আট দিন। সর্বশেষ সিডরের রাতে সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন তিনি।
এতবার ঝড়-ঝাপটার পর এখন তার সিদ্ধান্ত, আর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবেন না। নদীর কিনারে মাছ ধরবেন, লোকালয়ে কাজ করবেন। এভাবেই সংসারটা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এখন তার কাজ চিংড়ির পোনা ধরা। অবৈধ জেনেও এই কাজটি তাকে করতে হচ্ছে, কারণ জীবিকার বিকল্প কোনো পথ তার সামনে খোলা নেই। তবে বাস্তবতা, চিংড়ির পোনাও মিলছে খুবই কম।

কথা প্রসঙ্গে হাতে থাকা টাকা গুনতে গুনতে রতন হাওলাদার জানালেন, তিনদিনে যে চিংড়ির পোনা মিলেছে, তা বিক্রিতে পাওয়া গেছে মাত্র ৭৩ টাকা। এখান থেকে মেজ মেয়ে রনি ৩ টাকা নিয়ে গেছে। এটা দেখে সেজ মেয়ে মনি বায়না ধরলো ৫ টাকার।
সেজ মেয়েকে ৫ টাকা দেওয়ার পর তার হাতে থাকলো ৬৫ টাকা। এই টাকা নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ পর বাজারে যাচ্ছিলেন রতন হাওলাদার।
বাজার থেকে ফেরার সময় তার সঙ্গে আবারও দেখা হলে তিনি জানান, এক কেজি আলু আর এক কেজি পটল কেনা হয়েছে ৪৫ টাকায়। অবশিষ্ট ১৫ টাকা আছে বিশেষ কোনো প্রয়োজনে ব্যয়ের জন্য।
কথা বলার সময় পাশে এসে দাঁড়ান নূরুল ইসলাম। বয়স ৫৫ পেরিয়েছে। কষ্টের দিন অতিবাহিত করছেন তিনিও। ধারদেনা নেই, তবে দিনের রোজগারটা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ঘরের সামনে নদীর কিনারে বসে তার দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও মিলেনি সরকারি সহায়তা।

এই নূরুল ইসলামের ছেলে আসাদুল ইসলাম। ভ্যান চালিয়ে বাবার সংসার চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ১২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ভ্যান কিনেছে। রোজগার থাকুক বা না থাকুক আসাদকে ৩৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে। তার সঙ্গে কথা বলার সময় কিস্তি আদায়কারী হাজির। এদিকে আসাদের ছেলের নিউমোনিয়া হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সেখানে অনেক টাকার প্রয়োজন। এই ঝামেলায় ভ্যান চালাতে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। তার ওপর কিস্তির খড়গ। বোনের কাছ থেকে ২০০ টাকা ধার নিয়ে আসাদ কিস্তি শোধ করে আবার বলতে থাকে তার জীবনের গল্প।
কিছু বলার জন্য নদীর কিনারে ক্ষয়ে যাওয়ার বাঁধের পাশের ঝুঁপড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে আসেন হালিমা বেগম। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। একটি ম্যাক্সি গায়ে, সেটা ত্রাণে পাওয়া পুরানো কাপড় দিয়ে তৈরি। এ ছাড়া আরেকটা কাপড় আছে তার। নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য তার নেই। ঈদ-কোরবানি-রোজা কিংবা ঝড়-ঝাপটা হলে যে সাহায্য আসে তার মাধ্যমেই পোশাক সংগ্রহ করেন তিনি।
এক সপ্তাহে হালিমা বেগমের খাবারের তালিকাটা জানতে চাইলে স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না। কথায় মনে হলো, প্রায় সময়ই একবেলা রান্না দিয়ে তিন বেলা চালিয়ে দেন। চালের ব্যবস্থা না হলে চিড়া ভিজিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নেভান। পূর্ণমাত্রায় খাবার না পাওয়ায় শরীরের ক্ষতি বোঝেন, শারীরিক অনেক সমস্যাও হয়, কিন্তু কিছুই করার নেই।

পুরো এলাকা ঘুরে মনে হলো, বাসস্থান-খাদ্য-বস্ত্র মানুষের তিন মৌলিক অধিকারই এখানে বিপন্ন। সেই সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও বেশ কয়েকটি বিষয়, যা জীবন চলতে অতি দরকারি।
এই এলাকার মানুষ তাই অতিকষ্টে বলছেন, সরকার দেখে যাক বহু সংগ্রামে এভাবেও বেঁচে থাকতে পারে এদেশের মানুষ!
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৬ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৪