ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

বাল্যবিবাহ ও আমাদের দায়বদ্ধতা

শাহনাজ সুলতানা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১১
বাল্যবিবাহ ও আমাদের দায়বদ্ধতা

মাদারীপুর উপজেলার খালিয়ার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের আব্বাস আলীর কন্যা চাঁদনী আক্তার সামিরার বয়স ১২ বছর। কিছুদিন আগে পারিবারিকভাবে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল গোবিন্দপুর গ্রামের বিদেশফেরত অহিদুলের (২৭) সাথে।

কিন্তু এ বিয়েতে সামিরা আপত্তি জানালেও অভিভাবকরা তার মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে জোরপূর্বক বিয়ের আয়োজন করেন। কিশোরী সামিরা তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। জোরপূর্বক আয়োজিত এ বিয়ে ঠেকানোর জন্য কোনো উপায় না পেয়ে শেষে সহপাঠীদের সহযোগীতায় সে স্থানীয় সাংবাদিকদের ঘটনাটি জানায়। পরে এস আই কামালের নেতৃত্বে পুলিশ বিয়েবাড়িতে এসে সামিরার বিয়ে ভেঙ্গে দেয় এবং ওই সময় সামিরার বাবা ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে সামিরাকে কোথাও বিয়ে দেবেন না বলে পুলিশের কাছে অঙ্গীকার করেন।

গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম সামিরাকে। মাত্র বারো বছর বয়সে সাহস সঞ্চয় করে যেভাবে অভিভাবকদের অনৈতিক সিদ্ধান্তকে সে  কঠোরভাবে মোকাবিলা করেছে, সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের সমাজে প্রতিটি নারীর উচিত কেবল বাল্যবিবাহ নয়, যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিপে, যৌতুকসহ যত ধরনের ঘৃণ্যতম এবং মানবতাবিরোধী কর্মকা- রয়েছে তার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসা। বর্তমান বিশ্বে নারীরা পিছিয়ে নেই, পুরুষের সাথে সমানভাবে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন বিভিন্ন পেশায়। অবদান রাখছেন নানা সামাজিক কর্মকা-।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, এমন এক ধূসর সময় ছিল পৃথিবীতে, যখন নারীকে শুধু ভোগের বস্তুই মনে করা হতো। পরিবার বা সমাজ তাদের চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য দিত না। অনেকের ধারণা ছিল, নারী মানেই যৌনুধা মেটানোর আশ্রম আর সন্তান উৎপাদনের মেশিন। বিশেষ করে আমাদের পুরুষশাষিত সমাজে নারীরা ছিল বরাবরই অবহেলিত। এমনও সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি, সে সময়টাতে অধিকাংশ পরিবারে কন্যাসন্তান জন্মালে সদ্য প্রসূতি মায়ের ওপর  নেমে আসত পারিবারিক, সামাজিক নানা মানসিক নির্যাতন। এটা শুধু ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে আদি বর্বরতার যুগ পেরিয়ে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ নারী এখন অন্য কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে সুশিক্ষায় শিতি হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন এবং অনেকেই নিজ নিজ কর্মেক্ষেত্রে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে সফল নারী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন।

কিন্তু বিশ্বের বহু নারী যখন সোনালি স্বপ্ন চোখে নিয়ে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন আগামীর পথে, ঠিক তখনই গণমাধ্যমের কিছু কিছু খবর সত্যিই ভাবনায় ফেলে দেয়। প্রশ্ন জাগে আমরা কি আসলেই আদি যুগের ধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পেরেছি? এখনো কেন জানি মনে হয় সমাজের অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সনাতন ধ্যান-ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। তাদের অনেকেরই ধারণা, মেয়েদের লেখাপড়া করে কী হবে? তাদের তো ঘরেই থাকতে হবে। যে পুরুষ দু বেলা দু মুঠো ভাত এবং বছরে এক জোড়া কাপড় দিতে পারবে, সে পুরুষই তাদের মেয়ের জন্য উপযুক্ত । যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা নিজ মেয়েকে ওই পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচবেন। কিন্তু যে পুরুষটির সাথে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন, সে পুরুষটা যদি মেয়ের বয়সের চেয়ে দ্বিগুণ এবং অশিতিও হয় সেটাকে তারা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখেন না। তারা ভাবেন, বিয়ের জন্য শুধু একটি পুরুষ খুবই প্রয়োজন; তার শিক্ষা, বয়স এবং আচার আচরণ, অতীত কোনো কিছু নিয়ে তারা মোটেই তোয়াক্কা করেন না । এমনও দেখেছি বিয়ের বয়স হয়নি, লেখাপড়া বন্ধ করে দাদার বয়সী লোকের কাছে পনের-ষোল বছরের মেয়েদের বিয়ে দিতে। কিন্তু বিয়ে দেবার সময় একটিবারও অভিভাবকরা ভাবেন না যে,  মেয়ের নিজস্ব মতামত থাকতে পারে, বা বয়সের দ্বিগুণ পুরুষের সাথে অল্পবয়সী একটি মেয়ে কীভাবে বাকিটা জীবন কাটাবে। তাছাড়া অনেকাংশে দেখা যায় অল্প বয়সে বিয়ের পর ঘন ঘন বাচ্চা প্রসবের দরুণ অনেক মেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগেন এবং যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অনেক নারী মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এক জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধের দাবিতে বিভিন্নœ সময় বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে এবং তা বন্ধের লক্ষে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের আওতায় বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এ আইনে শিশুর বিয়েও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ সমস্যা প্রতিরোধে যথাযথ আইন থাকলেও বাস্তবে এ আইনের কতটুকু ব্যবহার হচ্ছে? ‘দ্য মেজরিটি অ্যাক্ট’ অনুসারে ১৮ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত হন না এবং তারা কোনো দেওয়ানি চুক্তিও করতে পারবেন না। মুসলিম বিয়ে যেহেতু একটি দেওয়ানি চুক্তি, কাজেই একজন নাবালক বা নাবালিকা নিজে কোনো চুক্তি করতে পারবেন না। তাছাড়া ১৯৭৪ সালের শিশু আইনটি সংশোধন করে ১৯৮৪ সালের সংশোধন অনুসারে বিয়েতে বর ও কনের বয়স পরিবর্তন করে বরের ক্ষেত্রে ২১ এবং কনের ক্ষেত্রে ১৮-এর নিচে বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারী শিশু আইন ও অন্যান্য আইনে ১৬ থেকে ১৮ বছর, এমনকি ২১ বছর বয়সী ব্যক্তিকে শিশু হিসাবে গণ্য করা না হলেও ১৯৮৪ সালের সংশোধনে ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং ১৮ বছরের কম বয়সী নারীকে বৈবাহিক ব্যাপারে শিশু ও নাবালক বা নাবালিকা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফলে যারা নিজের ইচ্ছায় অনুপযুক্ত বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন অথবা যাদের অভিভাবক কর্তৃক অনুপযুক্ত বয়সে বিবাহ সম্পন্ন হবে, তাদের উক্ত আইনের ৪, ৫, ও ৬ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তারা সর্বোচ্চ এক মাসের জেল অথবা ১ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- দ-ত হতে পারেন।

আমরা যারা বিলেতে বসবাস করি সবাই জানি, বিলেতে কোনো ছেলে বা মেয়েকে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে দেওয়া যায় না এবং জোরপূর্বক কোনো ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলে অভিভাবকদের কঠোর আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। আর এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রায় সব অভিভাবক তাদের সন্তানকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এছাড়া আগের তুলনায় বিলেতে অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন খুব সচেতন। সন্তানদের লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য যা যা প্রয়োজন নিজ সাধ্য অনুযায়ী তারা সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেন।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র মনে হয় একটু অন্যরকম। বিগত দিন এবং বর্তমানে অনেকাংশে দেখা যাচ্ছে, অনেক পরিবারের মেয়েদের বিয়ের উপযুক্ত বয়স হবার আগেই অভিভাবকরা চিন্তায় পড়ে যান। তবে এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে দারিদ্র্য, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, লিঙ্গবৈষম্যসহ নানা ধরনের চাপ। কিন্তু তাই বলে নিজ সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে তাদের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে অভিভাবকরা যখন মানবতাবিরোধী কঠোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন খুবই খারাপ লাগে। আমাদের সমাজে প্রতিটি অভিভাবকেরই উচিত এসব কুসংস্কার ত্যাগ করে নিজ সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষে তাদের  সহযোগিতা করা এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। বাল্যবিবাহ বন্ধের লক্ষে সমাজে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও সাহসী হতে হবে এবং জাতীয় এই সমস্যার বিরুদ্ধে সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশ সময় ০০২০, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।