ঢাকা: প্রতিদিন ভোরে লাঠিতে ভর দিয়ে দোকানে গিয়ে কর্মচারীর কাজ করেন ৭০ বছর বয়সী আমিন সর্দার। সারাদিন কাজ করে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফেরেন বাড়ি।
আমিন সর্দার ভেবেছিলেন সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে কর্মজীবী হিসেবে গড়ে তুললে তার কোনো অভাব থাকবে না। অন্তত বসে থেকে দু’বেলা দু’মুঠো নিশ্চিন্তে খেয়ে পরে জীবনের বাকি সময়টুকু পার করতে পারবেন। তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে বড় হয়ে ভালো উপার্জনও করছেন। সবাই ভালোও আছেন। তবে ভালো নেই আমিন সর্দার ও তার স্ত্রী।
এ বৃদ্ধের বাড়ি নাটোরে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, জীবনের বাকি সময় এরকম কাটবে কখনো ভাবেন নি। নিজের সন্তানদের যদি বিশ্বাস না করতে পারেন তাহলে কাকে বিশ্বাস করবেন? প্রশ্ন তার।
তিনি বলেন, একজন বাবার সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সন্তান। তাই সন্তানকে মানুষ করার জন্য সর্বস্ব হারিয়েছি এতে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু তা বলে আমার কষ্ট দেখে কি একটুও খারাপ লাগে না! এমন তো নয় যে, তারা আর্থিকভাবে খারাপ আছে।
শুধু আমিন সর্দার নন, অধিকাংশই বাবারই শেষ জীবনে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে একাধিক বাবার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। সবাই বলেছেন প্রায় একই ধরনের কথা।
রাজধানীর মহাখালী প্রধান সড়কের পাশে ফুটপাতে বাতির আলোয় মুখরোচক খাবার বিক্রি করছেন ৭৯ বছর বয়সী আমানত হোসেন। তার চার ছেলে ও দুই মেয়ে। সন্তানদের মধ্য কেউ না কেউ বুড়ো বয়সে তাদের দেখভালো করবে এই আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি হয় ২০ বছর আগেই।
বাধ্য হয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে রাজধানীতে কাজের সন্ধানে চলে আসেন। আমানত বলেন, সন্তানদের মধ্য একজন না একজন দেখভাল করবে এ গল্প প্রায়ই করতাম স্ত্রীর কাছে। কিন্তু সবাই যখন বড় হলো তখন যে যার মতো আলাদা হলো। শুধু আলাদা হতে পারলাম আমরা দু’জন। এগুলো বলে কি লাভ। তারা সবাই ভালো থাকুক এখন এই চাওয়া।
বাবাদের মহত্ব বুঝি এখানেই। সন্তানরা যতই কষ্ট বা অবহেলা করুক না কেন অন্তর থেকেই ওই একটাই শব্দই বের হয়ে আসে, তারা সবাই যেন ভালো থাকে।
কিন্তু যে সন্তানদের জন্য বাবাদের অনেক হাড়ভাড়া পরিশ্রম, সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে মানুষ করার আপ্রাণ চেষ্টা। সেই সন্তানরাই বড় হয়ে ভুলে যান বাবাদের সব অবদান।
ছেলে বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এই স্বপ্ন যখন বাবার মনে উঁকি দেয় তখন হয়তো ভুলেও বাবার মনে আসে না যে একদিন ওই ছেলে তার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে।
শনিবার গুলশান মহাখালী সড়কের মাঝামাঝি থেকে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে প্রায় ৬৫ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর ঝুড়ি হাতে বাসে উঠলেন। কারওয়ান বাজারে গিয়ে কাঁচাপণ্য কিনে বাড্ডা বাজারে বিক্রি করবেন।
কয় ছেলে আপনার প্রশ্ন করতেই বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তার চোখের দৃষ্টি চলে যায়। কোনো কথা বলেন না। অথচ একটু আগেও অনেক গল্প হচ্ছিল তার সঙ্গে।
সবশেষে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলে ওঠেন, কষ্ট করে ছেলেপুলেদের মানুষ করেছি। এখন তারা যার যার মতো খেটে খাচ্ছে। আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই। কয় ছেলে, কয় মেয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কি হবে!
সত্যি যে বাবাদের মতো কেউ কোনোদিন আপন করে ভালোবাসতে পারেন না। সেই বাবাদের বয়স যখন ৬০ এর বেশি হয়ে যায়, বৃদ্ধের তালিকায় নাম লেখান তখন তারা যেন সবচেয়ে অসহায়ত্বের বনে চলে যান।
আর বৃদ্ধাশ্রমে যেসব বাবারা আছেন তাদের অবস্থা যেন উল্টো। খাওয়া-পরার কোনো সমস্যা নেই, তবে নেই মানসিক শান্তি। একাকীত্ব যে কী ভয়াবহ তাদের সঙ্গে কথা না বললে বোঝার উপায় নেই। সবমিলিয়ে আসলেই ভালো নেই আমাদের ‘বাবা’-রা।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০২ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪