ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২, ০৯ মে ২০২৫, ১১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

৪৫৮ বছরে ঐতিহ্যবাহী জামাইবরণ মেলা

টি এম মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪:২৮, মে ২৫, ২০১৪
৪৫৮ বছরে ঐতিহ্যবাহী জামাইবরণ মেলা ছবি: সংগৃহীত

বগুড়া: বাঙালি সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যটা ৪৫৮ বছরের। উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী নামে।

তবে জামাইবরণ মেলা নামেও বেশ পরিচিত। প্রতিবছর উপজেলা সদরের প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে কেল্লাপোশী নামক স্থানে জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় রোববার থেকে এ মেলা শুরু হয়। জামাইবরণ ও শ্বশুরবাড়িতে নানা আচার পালন মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়।

ঐতিহ্য ধরে রাখতে অন্য বছরের মতো এবারও শুরু হতে যাচ্ছে বগুড়ার শেরপুরের জামাইবরণ মেলা।

মেলার ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে শনিবার মেলা প্রাঙ্গণের আশাপাশে গিয়ে তুলনামূলক বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেলা উপলক্ষ্যে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। জামাই-বউ নিয়ে ভিন্ন রকম আনন্দে মেতে ওঠেন তারা। শুধু এখানেই শেষ নয়, শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইকে মোটা অঙ্কের সেলামী দেওয়ারও রেওয়াজ রয়েছে এখানে। সেই সেলামী আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাইরা মেলা থেকে বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন, বড় মাছ, মহিষের মাংস ও খাসিসহ রকমারি খেলনা কিনে আনেন শ্বশুর বাড়িতে।

জামাইরা তাদের শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলায় ঘুরে সার্কাস, নাগোরদেলা, জাদু, পতুল নাচ দেখিয়ে দিনব্যাপী বিভিন্ন ধরনের আনন্দ উপভোগ করেন। মেলা শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরী খেলনা সামগ্রী, রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের বাহারী আসবাবপত্রসহ সারা বছরের জন্য বড় বড় ঝুড়ি ও চুন কিনে রাখেন।

মেলা প্রসঙ্গে ‘শেরপুরের ইতিহাস’ বইয়ের রচয়িতা সাবেক অধ্যক্ষ মো. রুস্তম আলী ও সংশ্লিষ্ট আমইন গ্রামের ৮৪ বছর বয়সী মোজাহার আলী বাংলানিউজকে জানান, যতদূর জানা যায়, ১৫৫৬ সাল থেকে এই মেলা হয়ে আসছে। কথিত আছে, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরসজাত এবং একজন দত্তক ছেলে ছিলেন। ঔরসজাত ছেলের নাম ছিল গাজী মিয়া আর দত্তক ছেলের নাম ছিল কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্ন্যাসীর বেশ ধরে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে এলে সেখানকার মুকুট রাজার একমাত্র মেয়ে চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন।

এক পর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার কাছে যান। মুকুট রাজা ফকিরবেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া দারুণ আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার কাছ থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক একটি দ‍ুর্গ নির্মাণ করেন। পরে জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় রোববার রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার করে চম্পা গাজীকে বিয়ে করেন।  

সে সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষ্যে কেল্লাপোশী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে। একই সময় সেখানে মাজার গড়ে উঠলে ভক্তরা আসর বসিয়ে মেলার মতো পরিবেশের সৃষ্টি করে। এরপর থেকে স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রত্যেক বছর জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

বাগরা গ্রামের ৬৮ বছর বয়সী গোলাম রব্বানী জানান, আত্মীয়-স্বজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো একটি বড় বাঁশে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রঙে সাজিয়ে এর বিভিন্ন স্থানে মানুষের চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দলের লাঠি ও মাদার খেলা। এ খেলা চলে মেলা শুরুর প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে। মেলায় থাকে যাত্রা, সার্কাস, নাগোরদোলা, পুতুল নাচ, বিচিত্রা, মোটরসাইকেল খেলা, কারখেলাসহ নানা রকমের খেলা।

তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, মেলা ঘিরে শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু লাখো মানুষের ভীড়ে প্রশাসনের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে এখানে। ফলে বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মেলা চলাকালীন সময়ে চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি রোধ করতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন।

বিষয়টির প্রতি প্রশাসনের বিশেষ নজর আশা করেন এলাকাবাসী।

বাংলাদেশ সময়: ০৪২০  ঘণ্টা, মে ২৪ ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।