ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-৫

বখাটেরা গোসলের ছবি তোলে, ঘর চান সবাই

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৩ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৪
বখাটেরা গোসলের ছবি তোলে, ঘর চান সবাই ছবি: নূর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: মাথার উপর ছাদ নেই অনেকের। অনেকেই আছেন জরাজীর্ণ ঘরে।

কয়েকশো, কখনো হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একটি বা দুটি টিউবওয়েল। তাই দৈনন্দিন পানির অভাব মেটানোর একমাত্র উৎস খাল বা নদী। বিপত্তি সেখানেও। নারীরা সেখানে গোসল করতে গেলে বাইরে থেকে বখাটেরা ছবি তোলে!
 
হাজারো সমস্যার মধ্যে শ্রীমঙ্গলের চা-শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত সহ্য করতে এসব সমস্যা। এখানেই শেষ নয়। ছেলে-মেয়েদের জন্য নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। চিকিৎসার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। স্যানিটেশনের অবস্থা দুর্বিষহ। একঘরে কখনো কখনো থাকতে হয় ১০-১২জন। যে মজুরি পায় তাতে তিনবেলা সবার পেট চলে না। শহরের কাছাকাছি বাগানগুলোর শ্রমিকরা কেউ কেউ বাইরে কাজ করে কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। কিন্তু বাইরের বাগানগুলোর অবস্থা বেশি ভয়াবহ।

অথচ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, অষ্টম অধ্যায়ে চা-বাগানের শ্রমিকদের শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রত্যেক শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ রয়েছে।
 
২০০৯ সালে চা-শ্রমিক ও মালিকপক্ষের চুক্তি অনুযায়ী বলা হয়েছে,
ক.
সংসদ তার সদস্যদের সুপারিশ আইন অনুযায়ী সকল সদস্যদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবে এবং আরো সম্মত হওয়া গেছে যে, শ্রকিদের বাসস্থান মেরামত এবং ব্যবস্থাপনার জন্য এর প্রজ্ঞাপন পুনরায় জারি করার ব্যাপারে।
খ.
শ্রমিকদের ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কিন্তু এই ল্যাট্রিনগুলোর দৈনন্দিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শ্রমিকদের নিজস্ব দায়িত্বে থাকবে।
গ.
সংসদ আরও সম্মত হয়েছে তার সদস্যদের সুপারিশ করতে যে আইন মোতাবেক যেন সকল শ্রমিকদের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

তবে এসব নিয়ম লিখিত আকারে থাকলেও ভাড়াউড়া ও কালীঘাটের বাগান ঘুরে কোথাও এর প্রয়োগ দেখা যায়নি। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হলে তারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
 
মঙ্গলা বাড়ৈ, সুমন ভৌমিক এবং আরও দুটি পরিবারের বসবাসের জন্য জায়গা নির্ধারিত দুই শতক। এর মধ্যে চার পরিবারের বসবাস। প্রতি পরিবারে আবার সদস্য রয়েছে ৫ থেকে ৮জন। কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই যদিও তাদের নামেমাত্র আছে, নেই কোনো শৌচাগার। অথচ কোম্পানি ও সরকারি শ্রম আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে চা-শ্রমিকদের জন্য অবশ্যই বসবাস ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার থাকতে হবে।

মঙ্গলা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের কোনো টয়লেট নেই। আপনারা ঘুরে দেখেন। কারও বাড়িতেই টয়লেট পাবেন না। অথচ কোম্পানির তৈরি করে দেওয়ার কথা। কোম্পানিকে বললে দিচ্ছি, দেব বলে আর দেয় না। বাধ্য হয়ে আমাদের ঝোপে ঝাড়ে, বাগানে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ মেটাতে হয়।
 
কোম্পানি থেকে পাওয়া সুযোগ সুবিধার কথা জানতে চাইলে সুমন বলেন, কিছুই তো পাই না। কি বলব। কোম্পানির ঘর দেওয়ার কথা দেয় না। আমাদের দুবেলা ভালো করে খাওয়াই হয় না। তারপরও কষ্ট করে কোনো রকম চাল তুলে ঘর করেছি।

সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির অবস্থা আরও খারাপ। পানির জন্য কখনও কখনও তাদের ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরেও যাওয়া লাগে। টিউবওয়েল রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে তাদের ভরসা করতে হয় খাল ও নদীর পানির উপর। কালীঘাটে গিয়ে দেখা যায় নদীতে নারী, পুরুষ, শিশু সবাই একসঙ্গে খোলা জায়গায় গোসল করছে। সেই পানিতে আবার কেউ থালাবাটি ধুচ্ছে, কেউ আবার নিয়ে যাচ্ছে কলসে করে।
 
রাধা হাজরা বলেন, রোদ ওঠার আগে কাজ না করতে পারলে খুব কষ্ট হয়। গাঙের জলই আমরা খাই, গোসল করি। টয়লেট নেই। আবার গোসলের সময় বাইরের মানুষ সুযোগ পেলে চুরি করে ছবি তোলে। এ নিয়ে অনেক মারামারি গণ্ডগোলও হয়েছে। তারপরও কোনো সমাধান নেই।
 
সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেকের রান্নাঘর নেই। খোলা জায়গায় একটি চুলা পেতেই কাজ করছে। কারও বাড়ির চাল অর্ধেক আছে, কারও অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। কোম্পানি কোনো নিয়মই মানে না।

শ্রমিক গোপাল বলেন, একঘরে আমরা বউ, বাচ্চা, বাবা, মা সবাই থাকি। ছোট্ট একটা ঘর। আপনারাই দেখেন। এভাবে কি থাকা যায় কুকুর বিড়ালের মতো!
 
শুধু তাই নয়, প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রতিজন স্থায়ী শ্রমিককে একটি করে নতুন গামছা ও টুপি দেওয়ার কথা থাকলেও তা পায় না অধিকাংশ শ্রমিক।
 
চা-শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরার দাবি, মালিকপক্ষ মন্ত্রী, এমপিসহ প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকে বলে ইউনিয়ন কিছু করতে পারে না।
তবে আগের চেয়ে ইউনিয়ন কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
 
গুরুতর অসুস্থ্ হলে প্রকৃত চিকিৎসাও পান না বেশির ভাগ শ্রমিক। আবরার বয়স ৪০। পায়ে কাজ করতে গিয়ে দায়ের কোপ লেগে পড়ে আছেন বিছানায়। কাজ করতে পারেন না ৬ মাসের বেশি হলো। উন্নত চিকিৎসার অভাবে কষ্টের সীমা নেই তার পরিবারের।
 
পাশে থাকা ফাল্গুনি, বাবুল, বৈশাখি বলেন, চিকিৎসা তো পাই-ই না, মরে গেলে পোড়ানোর লাকড়িও দেয় না।

এদের সবার দাবি, সবার আগে ঘর চাই। তারপর পানি, চিকিৎসা। আগে প্রাণ বাঁচাতে চান তারা। তারপর অন্য সুযোগ সুবিধা। ইতোমধ্যে আরও অনেক সুবিধা যে তাদের বাগান থেকে পাওয়ার কথা এটাই যেন ভুলে গেছে।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, ‘শ্রম আইনের ৩২ নং ধারা মোতাবেক একজন তার বাসস্থানের ভিটেমাটির অধিকার সংরক্ষণ করে না। এতে করে যেটা সমস্যা হয় তা হলে মালিক পক্ষ থেকে যে ঘর সরবরাহ করা হয় তা শ্রমিক পরিবারের জন্য ২০১৪ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশে মানবেতর জন্য চরম অবমাননাকর। একটা ছোট ঘরে স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে থাকা। আবার শ্রমিকরা যদি তার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে ওখানে যদি একটা পাকা ঘর নির্মাণ করতে চায় তবে তাদের তা করতে দেওয়া হয় না। সরকার, মালিকপক্ষ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো চা-শ্রমিকদের আবাসনসহ মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না।  

বাংলাদেশ চা বোর্ডের ‘টি সেল’ বিভাগের মহা-ব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান আকন্দ বাংলানিউজকে বলেন, শ্রমিকদের বাসস্থানের সমস্যাসহ চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি নানা সমস্যা দেখার দায়িত্ব ডিডিএল (ডেপুটি ডাইরেক্টার অব লেবার) এর। আরেকটি বিষয় হলো- বাগানের মোট লাভের শতকরা ৩ থেকে ৫ শতাংশ টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত। কিছু কিছু কোম্পানি অবশ্য এই নীতিমালা পালন করছে।

চা-শিল্প শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের উপ- পরিচালক (ডিডিএল) গিয়াস উদ্দিন বলেন, এগুলো সরাসরি আমাদের দেখার অধিকারের মধ্যে নেই। এটা শ্রম পরিদর্শকের দায়িত্ব। বাগান পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তখনই আমরা তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারি।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের উপ-মহা ব্যবস্থাপক (শ্রম পরিদর্শক) মো. আজিজুর রহমান বলেন, চা-বাগানে যদি এ ধরনের শ্রম আইন লংঘনজনিত কিছু হয়ে থাকে তবে শ্রমিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

** খোলা চা-বাগানই টয়লেট, আটার অর্ধেকই ভূষি!
** চোখ অন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ‘ঝুঁকি ভাতা’ আড়াই টাকা!
** বাগানে এখনো ব্রিটিশ শাসন!
** অসুস্থ হওয়া অপরাধ, নেই নারী ডাক্তার

বাংলাদেশ সময়: ০২০৩ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।