ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

সুন্দরবন এলাকার ঐতিহ্যবাহী বনবিবি মেলা

রণজিৎ বর্মন, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১১
সুন্দরবন এলাকার ঐতিহ্যবাহী বনবিবি মেলা

সুন্দরবনের দেব-দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনায় প্রথমেই যার কথা উল্লেখ করতে হয় তিনি বনবিবি। ইনি অরণ্যের দেবী বলে পূজিতা।

প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয় বনবিবি পূজা ও মেলা।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউপির জেলেখালী, রমজাননগর ইউপির কালিঞ্চি গ্রামে, বুড়িগোয়ালিনী ইউপির পানখালী গ্রামে, গোলাখালী গ্রামসহ সুন্দরবন সংলগ্ন কয়েকটি স্থানে মাঘ মাসের ১ তারিখে বনবিবি পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। জেলেখালী গ্রামের নীলকান্ত ফকিরের পুত্র সতিশ ফকির বর্তমানে নিজ উদ্যোগে এ পূজা করে আসছেন। একই গ্রামের প্রবীণ অনিল মণ্ডল ও জীতেন মণ্ডল  জানান, এই বনবিবি মেলার বয়স ১০০ বছর হতে চলেছে। তসিকা ফকিরের ঠাকুরদা যজ্ঞেশ্বর ফকির এ পূজা করে আসছেন। তারপর থেকে অদ্যাবধি চলছে।

তবে এ মেলা সপ্তাহব্যাপী বা তারও বেশি দিন স্থায়ী হতো। মেলা উপলক্ষে যাত্রা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা এসব বসত। এখন এক দিনে মেলা শেষ হয়। কালিঞ্চি গ্রামের তথা পূজাকমিটির সভাপতি হরিপদ মণ্ডল বলেন, তাদের এ বনবিবির মেলা বহুদিন আগে থেকে হয়ে আসছে। তবে স্থানাভাবে মেলার ব্যাপ্তি কম।

বনবিবি নামকরণের মধ্যে রয়েছে হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়। জেলেখালী পূজা অনুষ্ঠানের প্রধান কর্তাব্যক্তি সতিশ ফকির জানান, জল আর জঙ্গল মিলিয়ে সুন্দরবন। এর কোল ঘেঁষে বাস করে পরিশ্রমী মানুষ। তারা এই বনবিবিকে অতি আপনজন মনে করে বিপদে-আপদে স্মরণ করে। বিশেষ করে সুন্দরবন-নির্ভর জনগোষ্ঠী।

স্থানীয়দের বিশ্বাস, বনবিবি সুন্দরবনে যত্রতত্র যাতায়াত করেন। বাঘ-কুমিরসহ সমগ্র হিংস্র জন্তু তার অনুগত। বনবিবির ভাই হলো শাহজঙ্গুলী। কথিত আছে, ধোনাই ও মোনাই সপ্তডিঙ্গা নিয়ে সুন্দরবনে মধু ও মোম সংগ্রহ করতে যায়। এ সময়ে সাথে ছিল দুঃখিনী মাতার একমাত্র পুত্র দুঃখে। ধোনাই ও মোনাই  দক্ষিণরায়ের পূজা দিয়ে মধুর সন্ধানে বের হলে সারা দিন মধু খুঁজে না পেয়ে ফিরে নৌকায় ঘুমিয়ে পড়ে।  

দক্ষিণরায় তখন স্বপ্ন দেখায় দুঃখেকে বলি দিতে হবে তার ভোগে। ধোনাই মোনাই তাই স্থির করল এবং প্রচুর মধু ও মোম পেল। তারা নৌকা ভর্তি করে মধু বাড়িতে নিয়ে আসার পথে দুঃখেকে সুন্দরবনে রেখে এল। দক্ষিণরায় বাঘের বেশে দুঃখেকে খেতে এলে সে বনবিবিকে স্মরণ করে। বনবিবি তখন তাকে বাঁচিয়ে দক্ষিণরায়কে যুদ্ধে হারিয়ে দিলেন। এদিকে গাজী সুন্দরবনের জেলে-বনজীবীদের কাছে মৌলিক দেবতা। হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে স্মরণ করেন। গাজীর মুখে দাড়ি, পরনে লুঙ্গি, ঘাড়ে গামছা। দক্ষিণরায় বাঘের দেবতা হিসেবে পরিচিত।

বনবিবির পূজায় কোনো ব্রাক্ষ্মণ ছাড়াই ভক্তরা পুঁথি পড়ে পূজা বা শিন্নি দেন। পূজার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম খুঁজে না পাওয়া গেলেও বনবিবির নামে এই পূজায় বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট বনবিবির আকৃতির প্রতিমা নিয়ে বাদ্যবাজনাসহ এসে মানত দিতে দেখা যায়।

পূজার কর্তাব্যক্তিরা বলেন, প্রতিবছর বহুসংখ্যক লোক মানত দেন, এমনকি সন্তান-সন্ততি না হলে মানত করেন এবং সন্তান-সন্ততি হলে বনবিবির প্রতিমাসহ মানত দেন। কালিঞ্চি গ্রামে বনবিবির পূজার আয়োজন সাধারণত জেলে-বাওয়ালীরা করে থাকেন। সকল প্রতিমা তৈরিতে খরচ ১-২ হাজার টাকা। হরিপদ মন্ডল বলেন, বনের আরোধ্য দেবতা বনবিবি। পূজার প্রথম দিকে বনবিবির নামে ভক্তরা জীবন্ত মুরগি সুন্দরবনে ছেড়ে দিয়ে মানত করেন। জেলে-বাওয়ালী, মৌয়ালীরা সাধারণত বনবিবির পূজা বা শিন্নি দিয়ে জঙ্গলে উঠেন। পূজার প্রসাদ বাতাসা, চিনি ও ফল।

সুন্দরবন সংলগ্ন এই অতীত সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য বনবিবি মেলা বা বনবিবি পূজা ধরে রাখা প্রয়োজন বলে এলাকার সংস্কৃতিপ্রেমীরা মনে করেন।

বাংলাদেশ সময় ০০৩৫, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।