ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

যুদ্ধ ট্যাক্সি : পদাতিক সেনাদের বর্মযান

আহমেদ জুয়েল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১০
যুদ্ধ ট্যাক্সি : পদাতিক সেনাদের বর্মযান

যুদ্ধক্ষেত্রে আনা-নেওয়ার সময় শত্রুপক্ষের চোরা হামলা থেকে সেনাদের বাঁচাতে বিশেষ যান ব্যবহার করা দরকার। তাছাড়া পদাতিক বাহিনীর জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ কিংবা খাবার সরবরাহের জন্য দরকার হয় বিশেষ যানের।

আর এমন প্রয়োজন থেকেই উদ্ভাবিত হয়েছে যুদ্ধ ট্যাক্সি বা আর্মার্ড পারসনেল কেরিয়ার।

আর্মার্ড পারসনেল কেরিয়ার (এপিসি) বা যুদ্ধ ট্যাক্সি মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা বহনের এক বর্মযান। এ যানে সাধারণত মেশিনগান সংযুক্ত থাকে। তবে বিভিন্ন ধরনের বর্মযানে ধাক্কাহীন রাইফেল, অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড মিসাইল বা মর্টারও সংযুক্ত থাকে।

এ যান সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য নয়। বরং এটি সেনা বহনের সময় ওত পেতে থাকা শত্রুর অতর্কিত আক্রমণ বা গোলার টুকরা থেকে সেনাদের রক্ষা করে। চাকা বা ট্র্যাকওয়ালা দুই ধরনের বর্মযানই পৃথিবীতে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমেরিকান এম১১৩ ও ব্রিটিশ এফভি৪৩২ ট্র্যাকে চলে। আর ফ্রান্সের ভিএবি, ওলন্দাজ ও জার্মানির জিটিকে বক্সার এবং রাশিয়ার বিটিআর চাকায় চলে। একই ধরনের সমরাস্ত্র সজ্জিত আরেকটি যুদ্ধযান আছে যা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এই বর্মযানের নাম ‘ইনফ্যানট্রি ফাইটিং ভেহিকল’ বা পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধযান।

ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ট্যাংকের উন্নয়ন করা হয় তখন ব্রিটিশরা সেনা বহনের জন্য ছোট আকারের যাত্রী কমপার্টমেন্টের ডিজাইন তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে যার নাম হয় ‘মার্ক ভি’। এটাকেই আর্মার্ড পারসেনাল কেরিয়ারের প্রথম প্রজন্ম হিসেবে ধরা হয়। তবে বিশেষভাবে নির্মিত প্রথম যুদ্ধ ট্যাক্সি (এপিসি) তৈরি হয় ১৯১৮ সালে। যার নাম ‘মার্ক নাইন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই অর্ধ-ট্র্যাকের ‘এম৩’ এবং জার্মানের ‘এসডিকেএফজেড২৫১’ যানকে যুদ্ধ ট্যাক্সি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই যান দুটি পরবর্তী সময়ে উন্নত করা হয়। ঠিক একই সময়ে ব্রিটিশরাও অস্ত্র বহনের জন্য ‘ইউনিভার্সাল কেরিয়ার’ নামে একটি যান ব্যবহার করে।

সাধারণভাবে যুদ্ধ ট্যাক্সি বা এপিসি নিরাপদে সেনা বহনের জন্য ‘আর্মার্ড কার’ হিসেবেই পরিচিত। তবে যুদ্ধের সময় এগুলো বিভিন্নভাবেই ব্যবহৃত হয়। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এগুলো বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- সেনা বহনের জন্য, অস্ত্র বহনের জন্য, সেনাদের খাবার বহনের জন্য অথবা সংকট মুহূর্তে পিছু হটার জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে।

১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একজন জেনারেলের নির্দেশে এ ধরনের বর্মযানে স্বল্পপাল্লার খাটো কামান লাগানো হয়। পরে এটা অবশ্য তেমন কোনো কাজে লাগেনি। তাই কামান সরিয়ে ফেলে সেই অংশ স্টিল দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন ওই যানের নাম দেওয়া হয় ‘ক্যাঙ্গারু’।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ যুদ্ধ ট্যাক্সি উন্নত করেন। যুক্তরাষ্ট্র ‘এম১১৩’ নামে ট্র্যাকওয়ালা ৮০ হাজার বর্মযান তৈরি করে। সোভিয়েত রাশিয়াও বিটিআর-৪০, বিটিআর-১৫২, বিটিআর-৬০, বিটিআর-৭০, বিটিআর-৮০ ও বিটিআর-৯০ নামে আট চাকার এপিসি তৈরি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘এম১১৩’ এপিসি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনামের যুদ্ধে। ওই সময় ট্যাংকবিধ্বংসী  অস্ত্র হিসেবে এবং মেশিনগানের বিকল্প হিসেব এই বর্মযান অনেক কাজে লেগেছিল।

১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় দেখা যায়, এপিসিতে লাগানো মেশিনগান আসলে অরক্ষিত। শত্রুর গোলায় তা চুরমার হয়ে যায়। পরে মেশিনগানের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সঙ্গে বর্মযানের ওপরে বসা দুজন বন্দুকধারীরও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
এই যানই আধুনিক উন্নত এপিসির পুরনো সংস্করণ।

নকশা

বড় আকারে ট্যাংক ও বড় সিটি বাসের মতোই বেশির ভাগ যুদ্ধ ট্যাক্সি ডিজেল ইঞ্জিন চালিত। ‘এম১১৩’ যানটিও জেনারেল মটরসের ইঞ্জিন দিয়ে চলত।

অনেক যুদ্ধ ট্যাক্সি আবার উভচর। অর্থাৎ ডাঙা ও জলে চলতে পারে। ট্র্যাকওয়ালা যুদ্ধ ট্যাক্সি পানিতে ট্র্যাকের সাহায্যেই চলতে পারে। কিন্তু চাকাওয়ালাগুলোতে এজন্য আলাদা প্রপেলর বা ওয়াটার জেট লাগানো থাকে। পানিতে ৩ থেকে ৬ কিলোমিটার বেগে এগুলো ছুটতে পারে।

যুদ্ধ ট্যাক্সি সাধারণ স্টিল বা অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি, যা ছোটখাটো অস্ত্রের গোলা ও আগুন থেকে সেনাদের নিরাপদ রাখে। তবে যে কোনো ধরনের ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র যুদ্ধ ট্যাক্সি উড়িয়ে দিতে পারে। কিছু কিছু যুদ্ধ ট্যাক্সি আবার রাসায়নিক, জৈব, রশ্মি ও পরমাণু অস্ত্র প্রতিরোধী।

যানটিতে সাধারণত ১২ দশমিক ৭ থেকে ১৪ দশমিক ৫ মিলিমিটারের ভারি মেশিনগান অথবা স্বয়ংক্রিয় ক্যানন সংযুক্ত থাকে। কখনো কখনো লাগানো থাকে স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লাঞ্চার এবং ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল।

তবে সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি যুদ্ধ ট্যাক্সি থেকে আধুনিক যুগে পুলিশের জন্য যে বর্মযান তৈরি করা হয়েছে তার নকশা এবং আকৃতি কিছুটা ভিন্ন। তবে কাজ একই।
 
সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে মেশিনগানযুক্ত এই বর্মযান যোগ করা হয়েছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিরোধ ও কঠোর নিরাপত্তায় উন্নত বিশ্বের পুলিশ বাহিনীতে এই যান অনেক আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে।

বাংলাদেশ সময় ২২৩০,  ডিসেম্বর ২৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।