ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

নড়িয়ার মরাবাড়ি

একাত্তরের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী

তমাল ফেরদৌস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১০
একাত্তরের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী

সবার চোখের সামনে জড়ো হওয়া নারীদের মধ্য থেকে দু দফায় ছয় তরুণীকে ধরে নিয়ে গেল পাকবাহিনী। তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুক্তি পেল ৪০-৫০ জন নারী ও শিশু।

কিন্তু রেহাই পেলেন না পুরুষরা, জনাতিরিশেক মানুষকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হলো। তারপর শুরু হলো জ্বালাও-পোড়াও। পাক দলনেতার নির্দেশে রাজাকারচক্র কামিনী কুমার দেবের বাড়ির ১৯টি ঘর ও ছয়টি গোলাঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। কামিনী কুমার দেব ও তার স্ত্রী ঘটনার শুরু থেকেই নিজ ঘরে ছিলেন। পোড়া ভিটায় দুজনের কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় দুদিন পর।

প্রায় চল্লিশ বছরে দেশের জমিজমার হাতবদলের পাশাপাশি বাড়ির মালিকানা বদল হলেও এখনো বদল হয়নি স্বাধীনতার সময় কলঙ্কের চিহ্ন দিয়ে সেঁটে দেওয়া ‘মরাবাড়ি’ নামটি। ‘মরাবাড়ি’ হিসেবে স্বাধীনতার বলির সাী জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে শহীদ কামিনী কুমার দেবের বাড়ি। ২৫শে বৈশাখে হয়তো জেগে উঠে সম্মিলিত শহীদদের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ একসময় বাতাসে হারিয়ে যায় আকাশে। আমরা তা শুনতে পারি না।  

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আপার কাগাবলা ইউনিয়নের প্রান্তিক গ্রামের নাম নড়িয়া। হাওর পাড়ের এই গ্রামের প্রভাবশালী কামিনী কুমার দেবের ছিল ৩০০ বিঘা জমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকাররা পাকসেনাদের কাছে খবর পাঠায় মুক্তিবাহিনীর আস্তানা আছে এ গ্রামটিতে। রাজাকার ও পাকসেনারা ফন্দি আঁটে, দিন ঠিক করে ২৫শে বৈশাখ। পরিকল্পনামাফিক ওই দিন শেরপুর ক্যাম্প থেকে ১২ জন পাকসেনা সাধুহাটি গ্রাম হয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দেয় নড়িয়ার উদ্দেশে। তাদের বুটের আওয়াজ ও পায়ের ধ্বনি সারা গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ঘরবাড়ি ফেলে প্রাণ বাঁচাতে গ্রামের নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবাই ফারছা বিলে আত্মগোপন করে। স্থানীয় রাজাকাররা দলবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে তকবির ধ্বনি দিয়ে পাকসেনাদের স্বাগত জানায়। একসময় পাকসেনারা কামিনী কুমার দেবের বাড়িতে অবস্থান নেয়। স্থানীয় রাজাকারচক্র নারিকেল গাছ থেকে ডাব-নারিকেল এনে তাদের আপ্যায়ন করে।

বাড়িতে লোকজন না দেখে পাকসেনা ও রাজাকাররা পরিকল্পনা করে ফারছার বিলে অবস্থান নেওয়া হিন্দু পরিবারগুলোকে বাড়িতে আসার জন্য খবর পাঠায়। বিলের ঝোঁপঝাড়ের অন্তরালে, ঢোল-কলমীর আড়ালে আশ্রয় নেওয়া শতাধিক হিন্দু নারী-পুরুষ যার যার বাড়িতে ফিরে আসে। উপস্থিত সবাইকে জড়ো করা হয় কামিনী কুমার দেবের বাড়িতে। নারী-শিশুদের জড়ো করা হয় বাড়ির উঠোনে এবং পুরুষদের জড়ো করা হয় বাড়ির দেিণর ঢালুতে। একপর্যায়ে জড়ো হওয়া নারীদের থেকে প্রথমে তিন তরুণীকে তিন পাকসেনা কামিনী কুমার দেবের বাড়ির একটি খালি ঘরে নিয়ে গিয়ে তাদের সম্ভ্রমহানি করে। এরপর আরো তিন তরুণীকে একইভাবে নিয়ে যায়।

এ সময় কামিনী দেবের পুকুরপাড়ে অবস্থান নেওয়া এক পাকসেনার অনবরত ব্রাশফায়ারে লুটিয়ে পড়ে ৩০-৩২ জন লোক। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য উঠোনে অবস্থান নেওয়া আরো দুজন সৈনিক গুলি ছুড়তে থাকে। হতভাগ্য নিহতদের মধ্যে ছিলেন অখিল দেব, প্রসেন্দ্র দেব, শ্রীধর দেব, দয়া দেব, পেচন দেব, গঙ্গাচরণ দেব, সাধন দেব, উমেশ দেব, দশাই দেব, গৌরীচরণ দেব, নকুল দেব, সমীরণ দেব, যোগীন্দ্র দেব, সুদানন্দ দেব, সধর দেব, রসিক বৈদ্য, যতীন্দ্র দেব, উমেশ বৈদ্য, সুনা বৈদ্য, হরেন্দ্র বৈদ্য, নিখিল বৈদ্য, উজেল বৈদ্য, দীগেন্দ্র বৈদ্য, হরিবল বৈদ্য, মহাদেব বৈদ্য প্রমুখ। তবে আলৌকিকভাবে বেঁচে যান প্রভাত চন্দ্র দেব, অবিনাশ দেব, সুকুমার দেব, নরেন্দ্র দেব ও সমীরণ দেব। চারজনের গায়ে বুলেট লাগলেও স্তূপীকৃত লাশের নিচে পড়ে দুজন এবং অপর দুজন দৌড়ে প্রাণে রা পান। প্রভাত চন্দ্র দেব ছিলেন অত অবস্থায়। তিনি বলেন, ঘাতক সেনার নিশানা দেখেই তিনি শুয়ে পড়েন। তার ওপর লুটিয়ে পড়ে পাঁচটি দেহ। তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। যখন হুঁশ ফিরে আসে তখন দেখেন লাশের স্তূপ। পুরুষদের প্রাণে মারার পর উঠোনে জড়ো হওয়া নারী-শিশুকে হত্যা করা হবে নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে তা নিয়ে খটকা বাঁধে।

সে সময়ে নড়িয়া গ্রামে অবস্থানকালে মৌলভীবাজার শহরের মধ্যপাড়ার রাজাকার আবদুস সালাম ঘটনার নাটকীয়তায় বিমূঢ় হয়ে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা কইছলায় কিতা আর করলায় কিতা...। সেনা কর্মকর্তাটি তখন যেন কিছুটা মার্জিত। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, সব রেন্ডিকো ছোড় দোও। এভাবে মুক্তি পায় ৪০-৫০ জন নারী ও শিশু। কিন্তু এরপরই পাক দলনেতার নির্দেশে রাজাকারচক্র কামিনী দেবের বাড়ির ১৯টি ঘর ও ছয়টি গোলাঘরে আগুন ধরায়। পোড়া ভিটায় কামিনী কুমার দেব ও তার স্ত্রীর কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় দু দিন পর। জ্বলে যাওয়া হিন্দু বাড়িগুলোতে লুটপাট চলে। এদিকে লাশ স্তূপীকৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় বিদঘুটে গন্ধ ছড়াচ্ছিল। গন্ধের কারণে দালালরা ঘোষণা দিল, মরা মানুষগুলোকে সৎকার না করলে তাদের জীবিত আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হবে। এই ঘোষণা শুনে নিকটবর্তী আবদালপুর, নোয়াগাঁও, খাগড়াকান্দি গ্রামে আশ্রয় নেওয়া নিহতদের ৫-৬ জন স্বজন এসে গর্ত খুঁড়ে ২৯টি শবদেহকে একই গর্তে মাটি চাপা দিয়ে যায়। বধ্যভূমির স্মৃতি ধারণ করে ঢিবির মতো এই গণসমাধি এখনও টিকে আছে।

’৭৫-এর পট-পরিবর্তনের পর পরিকল্পিত ডাকাতির তান্ডবে কামিনী কুমার দেবের উত্তরসূরিরা বাড়ি ও সম্পত্তি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেলেও বধ্যভূমিটি বিক্রি করেননি। প্রতি বছর ২৫শে বৈশাখ এলে নিহতদের উত্তরসূরিরা এই বধ্যভূমিতে এসে কিছু সময় মৌনতা পালন করেন এবং স্বজন হারানোর দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে যার অবস্থানে ফিরে যান।

ঘটনার প্রত্যদর্শী ১০৬ বছরের বৃদ্ধ নন্দলাল বৈদ্য সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিলেন এভাবে : স্বাধীনতার সময় বৈশাখ মাসের শেষ ভাগে বেলা ৩টা কি সাড়ে তিনটার সময় পাঞ্জাবি আইছে। এই দিন আমি ছিলাম কামিনী দেবের বাড়ি। এ সময় কামিনী দেবের ভাতিজা দৌড়ে বাড়িতে ঢুকতেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কেন তুমি দৌড়াচ্ছ? তখন সে বলছে আমার বাড়িতে পাঞ্জাবিরা ঢুকে পড়েছে। এ সময় আমি বাড়ির দিকে চেয়ে দেখি আমার বাড়ির মেয়েলোকসহ  সবাই পূর্বের বন্দে (হাওরের দিকে) দিয়া বের হয়ে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে কামিনী দেবের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। তখন ভাদগাঁও গ্রামের খলিল মিয়া, সজ্জাদ মিয়া গং আমার বাড়ির মেয়েলোকদের নিয়ে নিরাপদে রেখেছে। এ সময় কিছু মানুষকে আমাদের গ্রামের রাজাকাররা বলেছে, আমাদের সাথে আসো, শুধু কিছু কথা জিজ্ঞেস করবে পাকিস্তানি বাহিনী; আর কিছু নয়। এদের নিয়ে গিয়ে কামিনী দেবের বাড়িতে লাইন ধরে বসিয়েছে। আমাদের গ্রামের মুরব্বি-সকলও বসেছেন এবং কী যেন আলোচনা করছেন। আমি বসে আছি আমার ছোট ঘরের দণি পাড়ে উড়ার (ধানের ন্যাড়া দিয়ে বানানো বসার জায়গা) ওপরে। হঠাৎ দেখি মানুষকে দেখা যায় না। দিনের আলোর মধ্যে কুয়াশার মতো অবস্থা হয়েছে। মানুষ তখন চিৎকার করে বলছে গ্যাস ছাড়ছে গ্যাস ছাড়ছে। কিছুণ পরে শুনি ঢুল ঢুলি ঢুল ঢুলি (বিকট শব্দ) আওয়াজ শোনা যায়। এই তো সব শেষ।

‘এ সময় কামিনী দেবের বাড়ি থেকে দু দফায় ছয়জন মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। এরা ছিল মারা (নিম্নবর্ণের) সম্প্রদায়ের। বাড়িতে আসার পর মফিজ উল্যা বলছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ফেলার জন্য। আমি তখন রাগে ােভে তাকে বলেছি জ্বালিয়ে ফেলো। তখন কামিনী কুমার দেব ও তার স্ত্রী ঘরের ভেতর হার্টফেইল (হার্ট অ্যাটাক) করে আগুনে জ্বলেপুড়ে মরেছে। পরে বাড়িতে জড়ো করা শিশু ও মহিলাদের রাজাকাররা বলেছে চলে যাও। তখন সবাই দৌড়ে পালিয়ে গেছে। গুলি করে মেরে ফেলা লাশগুলো কামিনী কুমার দেবের বাড়ির দণি পাশে ফেলে দেওয়া হয়। গ্রামের মানুষ আমাদের এসে বলেছে তোমরা লাশ ঠাবাও (সৎকার) করো। তখন উপস্থিত আমরা বলেছি পারব না। যার ইচ্ছা সৎকার করতে পারো। তখন মারা সমাজের লোকজন গর্ত খুঁড়ে ২৬ জনের লাশ ফেলে দিয়েছে। ’
 
নন্দলাল বৈদ্য ােভের সাথে বলেন, যুদ্ধের সময় যারা রাজাকার ছিল তারা এখন আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে গেছে। আমি বেঁচে থাকতে মনে হয় এদের বিচার দেখব না।  

নন্দলাল বৈদ্যের ছেলে ইরেশ বৈদ্য ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে : শেরপুর থেকে যখন মুক্তিযোদ্ধারা চলে যান, তখন চৈত্র মাসে আমরা ভারত চলে যাই। সেখান থেকে এসে জানলাম আমার কাকাসহ বংশধরদের মেরে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর বাড়িতে এসে শুনলাম গোলার ধান লুটপাট, গরু-ছাগল-মহিষ নিয়ে গেছে। তারপর আমার বাবা মামলা করে কিছু উদ্ধার করেছেন। তিনি বলেন, বধ্যভূমির জায়গাটি যারা বাড়ি কিনেছে তারা ক্ষেতের জমি বানিয়ে ফেলেছে। তবে বাড়ির লোকজন বলেছে, যদি তোমরা কিছু করতে চাও তাহলে দিয়ে দেব। প্রতি বছর কামিনী কুমার দেবের নাতি অবিনাশ ও তার মা এই বধ্যভূমিটি দেখে যান।

কামিনী কুমার দেবের বংশধররা বাড়ির দণিপাশে বধ্যভূমির জন্য ১৬ শতক জমি দান করলেও এখন বেদখল হয়ে ৪-৫ শতক অবশিষ্ট রয়েছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও এই বধ্যভূমিতে
কোনও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি।

বাংলাদেশ সময় ১৬৩০, ডিসেম্বর ১৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।