ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

ইন্দিরা গান্ধী আবেগে জড়িয়ে ধরেন কিশোর যোদ্ধা বাহাউদ্দিনকে

মোস্তফা হোসেইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১০
ইন্দিরা গান্ধী আবেগে জড়িয়ে ধরেন কিশোর যোদ্ধা বাহাউদ্দিনকে

বিজয় দেখেছিলেন বাহাউদ্দিন রেজা বীর প্রতীক। বিশাল সে বিজয়।

তখন তিনি স্কুলছাত্র। দেখলেন, দেশের মানুষ শক্তিশালী শাসক আইয়ুব খানকে পরাভূত করে দিয়েছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে। বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে আনতে পেরেছিল তারা। কিশোর রেজার ভাগ্য হয়েছিল সেই মুক্তির আন্দোলনে নিজেকে জড়িত করার। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নোয়াপাড়া ছাড়েন। ভর্তি হন কুমিল্লা শহরের ইউসুফ হাইস্কুলে। থাকতেন একটি মেসবাড়িতে। সুতরাং অফুরন্ত সুযোগ তাঁর সামনে। বেরিয়ে পড়েন রাজপথে। অনুসরণ করেন বড়দের।

মনে আছে কাজী জহুরুল কাইউম, অধ্যাপক খোরশেদ আলম, অধ্য আব্দুর রউফ ও আফজাল খানের কথা।   তাঁরা ছিলেন কুমিল্লা জেলার আওয়ামী লীগ নেতা। দিকনির্দেশনা দিতেন মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁদের সঙ্গে মিছিলে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর আন্দোলনে অংশ নেওয়াটা। তখন অনেক মানুষের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাতেন তিনিও। স্লোগান ধরতেন : পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। সেই স্লোগানের সঙ্গে এক সময় আরো যোগ হলো : বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। গলা ছেড়ে স্লোগান ধরলেন, জয় বাংলা।

ইতোমধ্যে অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। অনেক বন্ধু রাজপথে তাঁর সঙ্গী। নিত্য দেখা কুমিল্লা শহরই যেন বদলে যেতে থাকে তাঁর চোখের সামনে। চতুর্দিকে যেন সাজ সাজ রব। সবার একই কথা, শেখ মুজিবের দলকে বিজয়ী করতে হবে। সেই আনন্দের মিছিলেও কিশোর রেজা যোগ দিলেন সহযোগী হিসেবে। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন জানায়। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ বিশাল বিজয় অর্জন করে নির্বাচনে।

তিনি দেখলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক তারপরও শোষণ চালানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। হত্যা খুন চালিয়ে যেতে থাকে নির্বিচারে। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানিরাও নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়। একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে লাখ জনতার সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বললেন বঙ্গবন্ধু। ডাক দিলেন যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই যেন শত্রুর মোকাবিলা করে সবাই।

সেই ডাক পৌঁছায় কিশোর বাহাউদ্দিনের কাছেও। তিনি উদ্বুদ্ধ হলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য। কিন্তু তখনো জানতেন না স্বাধীনতার জন্য মানুষকে অকাতরে জীবন দিতে হবে।   এ আন্দোলনের মিছিল যে অন্যরকম মনে হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ, ছেলে মেয়ে বুড়ো খোকা সবাই ছুটছে। শহর ছেড়ে দিচ্ছে তারা। যাচ্ছে গ্রামের দিকে। পেছনে যেন পোড়ামাটির শহর।
 
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করে কুমিল্লা শহরে। দেশের অন্যত্রও গুলি হয়। অকাতরে মারা যায় মানুষ। জীবনের মায়ায় বাহাউদ্দিনও দ্রুত শহর ছেড়ে চলে যান গ্রামে। কিন্তু ওখানে থাকাটাও কতটা নিরাপদ। অসংখ্য মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছে গ্রামে। সবার মধ্যে আতঙ্ক। কী হবে দেশের?

মনে আসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের কথা। বলেছিলেন, তিনি যদি পরবর্তীকালে নির্দেশ দিতে নাও পারেন, তাহলে যেন রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই নির্দেশ গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে তারও আগেই। সুতরাং গ্রামের মানুষও প্রতিরোধ গড়ে তোলে সারা বাংলায়। চৌদ্দগ্রাম উপজেলাও বাদ যায়নি। গাছ ফেলে চট্টগ্রাম-ঢাকা রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাস্তার মাঝখানে গর্ত করে গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী করে দেওয়া হয়। আর সেই কাজে বাহাউদ্দিনও অংশ নেন। ঐ সময় তাঁরা চিওরা ও আমজাদের বাজার এলাকার দুটি ব্রিজ ভেঙ্গে দেন। বিশাল বটগাছ রাস্তায় ফেলে দেন সাধারণ মানুষকে নিয়ে। তার কয়েক দিন পর জগন্নাথ দীঘি ইপিআর ক্যা¤েপ যান তাঁরা। সেখানে বিহারি ছিল একজন।

বাহাউদ্দিন সাধারণ মানুষকে নিয়ে ইপিআর ক্যাম্পের অস্ত্র কেড়ে নেন। বিহারি সৈনিকটিকে সাধারণ মানুষের কাছে ছেড়ে দেওয়া হলে তারা তাকে ক্যাম্পের কাছে এক জায়গায় নিয়ে মেরে ফেলে।

সেখান থেকে তিনি চলে আসেন চৌদ্দগ্রাম থানায়। সঙ্গে শত শত মানুষ। সবাই মিলে সেখানকার অস্ত্র নিয়ে নেন। চৌদ্দগ্রাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আব্দুল কাদের  চৌধুরী, থানা থেকে অস্ত্র নেওয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বাহাউদ্দিন কিছু অস্ত্র নিয়ে চলে আসেন মিয়ার বাজার। ওখান থেকে ভারতের কাঁঠালিয়া  চলে যান তিনি। তখন হাজার হাজার মানুষ ভারতে চলে যাচ্ছে প্রাণের মায়ায়। সোনামুড়ায় দেখা হয় কুমিল্লা জেলার আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক খুরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ও শিক।

সময়টা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। তিনি বললেন, মতিনগর যাওয়ার জন্য। যাওয়ার পথে দেখা হল ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে। তাঁর হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বাহাউদ্দিনের হাতে তখনো অস্ত্র ছিল। ক্যাপ্টেন হায়দার সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই জন্যই তিনি তাকে নিজের গাড়িতে তুলে নিলেন।

ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি বললেন অস্ত্র প্রশিণ নিতে হবে। তারপর তিনি আবার পাঠালেন কাঁঠালিয়া প্রশিণ কেন্দ্রে। ওখানে মাত্র সাতদিন ট্রেনিং দেওয়া হয়। রাতদিন চলে প্রশিণ।

প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাপ্টেন হায়দার বাহাউদ্দিনকে পাঠানো হয় বিবির বাজার এলাকায়। ওখানে ছিলেন আকবর হোসেন। তিনি পরবর্তীকালে লে. কর্নেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন  ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওখানে স্লুয়েজগেট এলাকা দখল করার জন্য যুদ্ধ করতে হবে এই উদ্দেশে এগিয়ে আসেন তাঁরা।

এপ্রিল মাসের শেষের দিক। কাস্টম অফিসের কাছে এই এলাকায় ডিফেন্স গড়ে ওঠে। সেখানে তৃতীয় দিনে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। রাত দুইটার দিকে বাহাউদ্দিন আকবর হোসেনের কাছে আসেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার পর কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তিনি আকবর হোসেনের পাশেই একটু জায়গা করে শুয়ে পড়েন। উদ্দেশ্য আবার ভোর হতেই চলে যাবেন বাংকারে। কিন্তু শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম চলে আসে।

কাস্টম অফিসের পাশে যে পুকুর আছে সেই পুকুরপাড়ে চলে আসে আর্মি। ক্যাপ্টেন আকবর প্রথমে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন। তাতেও বাহাউদ্দিনের ঘুম না ভাঙ্গলে তিনি তার চুল ও শার্টের কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যান। কয়েক গজ দূরেই ছিল ধানতে। সেই ধানেেত যাওয়ার আগেই পুরোপুরি সজাগ হয়ে যান বাহাউদ্দিন। তখনই দেখতে পান যে আর্মি খুব কাছে চলে এসেছে। কয়েক মিনিট যেতেই তিনি দেখতে পান, একটু আগে তারা যেই মেশিনঘরে শুয়ে ছিলেন সেই ঘরের ভিতরে ঢুকছে পাকিস্তানি বাহিনী। তার মানে হচ্ছে, আকবর হোসেন যদি তাকে টেনে না বের করতেন তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু হতো তার।

তারপর পাকিস্তানিরা বিবির বাজার ও তার কাছাকাছি অনেক গ্রাম দখল করে নেয়। এরপর শালদানদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়া বুড়িচং বিশাল এলাকায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করে।

জুন মাসের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন হায়দার তাকে দায়িত্ব দিলেন কুমিল্লা যাওয়ার জন্য। বললেন, মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ক্যাপ্টেন হায়দারের প্রতি নাখোশ হয়েছেন। কারণ হিসেবে পাকিস্তান রেডিওর একটি সংবাদের কথা উল্লেখ করা হলো। রেডিওতে খবর প্রচারিত হয়েছে যে, কুমিল্লা শহরে কোনো মুক্তিযোদ্ধার অস্তিত্ব নেই। যে কারণে সেখানে সাধারণ জীবনযাত্রা চলছে। কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে শহর থেকে। তার মানে ওখানে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা থেমে গেছে। যেহেতু বিষয়টি কর্নেল ওসমানী  পর্যস্ত আলোচিত হয়েছে তাই ক্যাপ্টেন হায়দার অত্যন্ত গুরুত্বসহ বিবেচনা করলেন। তিনি বাহাউদ্দিনকে বললেন, কুমিল্লায় কিছু একটা করতে হবে।

জামাল কবির (পরবর্তীকালে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত) ও বাহাউদ্দিন রওনা হন কুমিল্লার  উদ্দেশে। কমান্ডো গ্রুপ তৈরি করা হলো সেই অপারেশনের জন্য। সঙ্গে যান সাকিল, খোকনের মতো আটজন। গ্রুপ কমান্ডার নিয়োজিত হন বাহাউদ্দিন। তারা গোমতী নদীর উত্তরপাড়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে রেকি করেন দিনের বেলায়। নৌকার মাঝি ছিলেন আবুল মিয়া। গয়াম বাগিচা থেকে আবুল মিয়ার সঙ্গে তাদের কথা হয়। বাহাউদ্দিন আবুল মিয়ার গায়ের জামাটা গায়ে দেন। নিজের জামাটা দেন আবুল মিয়াকে। কারণ আবুল মিয়ার জামার দুই পকেটে গ্রেনেড রাখার সুবিধা হবে।

দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি সৈনিক ছিল ক্যাপ্টেন বোখারি। তাকে জীবিত কিংবা মৃত ধরার জন্য কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নদী পেরিয়ে শহরের মধ্যে আসাটা একটু কঠিন ছিল। তারপরও যেতে হবে কুমিল্লায়। প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যান তাঁরা। ইউনাইটেড কমার্শিয়েল ব্যাংক (বর্তমান জনতা ব্যাংক), বর্তমানের সোনালী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, জজ কোর্ট এমন আটটি টার্গেট ছিল তাদের সামনে।

তাদের কৌশল ছিল, কমান্ডো স্টাইলে আক্রমণ। শহরের ভিতরে এসে জনপদে গ্রেনেড চার্জ করে চলে যেতে হবে। অবশ্যই সেগুলো যেন সফল হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে। অন্তত পাকিস্তানি বাহিনী যাতে এ কথা মনে করতে না পারে যে কুমিল্লায় আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। কিংবা এই শহরটিও তাদের  স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আটজনকে ৪টি ভাগ করা হয়। প্রতিটি ভাগের একজনের হাতে শুধু গ্রেনেড, অন্যজনের হাতে গ্রেনেড ও পিস্তল।

বাহাউদ্দিনের হাতেও ছিল একটি পিস্তল ও দুটি গ্রেনেড। কমার্স ব্যাংকে গেলেন বাহাউদ্দিন, খোকন গেল জিলা স্কুল, সোনালী ব্যাংকে গেল জামাল, আরেকজন গেল জজ কোর্ট। সবাই লুঙ্গি পরা। বাহাউদ্দিন মোগলটুলী ঢুকে গেলেন আনসার আহমদের ভাই মোস্তফার দোকানে। মোস্তফা তাকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে যায়। কিন্তু তিনি তাকে বারণ করেন বেশি কথা বলতে। মোস্তফা তাকে বলেন, রেজা ভাই আপনের কি কোনো টাকা-পয়সা লাগবে? রেজা ৫ টাকা চাইলেন। মোস্তফা ক্যাশ খালি করে নিয়ে আসে বাহাউদ্দিনের সামনে। বাহাউদ্দিন ৫ টাকা নিয়ে বাকিটা ফেরত দিয়ে দেন। মিনিট তিনেক ছিলেন সেখানে। পানি খেয়ে আবার রওনা হন অপারেশনের উদ্দেশে।

বেলা সাড়ে দশটা বাজে। কমার্স ব্যাংকে ঢুকে বসেন একটি বেঞ্চিতে। এর মধ্যে ব্যাংকের একজন এসে জিজ্ঞেস করেন, কী চান আপনি? বাহাউদ্দিন বলেন, আমার সাহেব আসার কথা। আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। লোকটিও তার কথা বিশ্বাস করে।

ইতোমধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে বেশি সময় কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সুতরাং ঝটপট কাজ শেষ করে নিরাপদে সরে যেতে হবে। সন্তর্পণে হাত ঢুকিয়ে দিলেন পকেটে। গ্রেনেড
রেডি করে অতি দ্রুত ব্যাংকের ভিতর নিক্ষেপ করেন। প্রচণ্ড শব্দে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়।
কিন্তু বাহাউদ্দিন ব্যাংকের ভেতরে থাকার কারণে গ্রেনেডের স্পি­ন্টার এসে তার গায়েও বিঁধে যায়। আঙ্গুলের মাথাটি উড়ে যায় তার। অন্যান্য জায়গাতেও স্পি­ন্টার ঢুকে যায়। কিন্ত তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। দ্রুত বেরিয়ে পড়েন। রক্ত ঝরছে। ছাতি পট্টি দিয়ে খেয়াঘাটের দিকে তিনি দৌড়াতে থাকেন।
চাঁনপুর গিয়ে তিনি খেয়ায় চড়বেন। গাঙআইলে যাওয়ার পরই এক রাজাকারের সামনে পড়েন। রাজাকারটি সাইকেল দিয়ে তার পথ আটকে ফেলে। এগিয়ে আসে বাহাউদ্দিনের দিকে। বাহাউদ্দিন তখন প্রচণ্ড কান্ত। কারণ তার আগে কয়েক কিলোমিটার প্রাণপণ দৌড়েছেন তিনি। তার মনে হয় রাজাকারটি যদি তাকে একটি থাপ্পরও মারে তাহলেও তার পে বেঁচে ওঠা সম্ভব হবে না।
কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে ভীত হলে চলবে না। আবার রাজাকারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করার মতো বলও তাঁর নেই। তাই তিনি কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হিসেবে রাজাকারের সঙ্গে কথা বলার চিন্তা করলেন। ইতোমধ্যে রাজাকারটি তার শরীরে তল্লাশি করার চেষ্টা করতে থাকে। বলে, তুমি নিশ্চিত মুক্তিযোদ্ধা, তুমিই বোধহয় বোমা ফাটিয়ে এসেছো। তোমার গায়ে রক্ত পড়ছে সেই কারণেই।

অন্তত মিনিটখানেক দাঁড়ানোর সুযোগ হয় তাঁর। আস্তে আস্তে নেমে যান পাশের ধানেেত। ওখান থেকে আঁজলা ভরে কিছু পানি খেয়ে নেন। ততণে তিনি কিছুটা শক্তি ফিরে পান। তখন তাঁর মনে হয়, রাজাকারটাকে কিছু মজা দেখানোর দরকার। না হলে তাকে জীবন দিতে হবে। রাজাকারটা আবার এগিয়ে আসে। এক পর্যায়ে সে বাহাউদ্দিনের কলার ধরে টানতে থাকে। রাজাকারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তার সহ্যের সীমা ছাড়ায়।   তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় কষে মারলেন একটা লাথি। রাজাকারটা আসলে আকস্মিক এমন আঘাত আসতে পারে চিন্তা করতে পারেনি। সে গড়িয়ে পড়ে আইলের পাশে। তখনই বাহাউদ্দিনের মনে পড়ে রাজাকারটি সুযোগ পেলে গুলি করে বসবে। তাই তিনি দ্রুত গতিতে পিস্তল বের করে নেন। এক রাউন্ড গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ রাজাকারটি সেখানেই পড়ে থাকে। তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। চলে আসেন খেয়াঘাটে। সেখানে আবুল তৈরি ছিল নৌকায়। আবুল মিয়া তাড়াতাড়ি তাকে নদী পার করে দেন। তিনি জানতে পারেন জামাল খোকন এরা তখনো আসেনি।

বাহাউদ্দিনের গায়ে যে রক্তাক্ত জামা ছিল সেটি তাকে দিয়েছিলেন আবুল মিয়া। এটি তাঁর নিজেরই জামা ছিল। পকেট থাকার কারণে এটি চেয়ে নিয়েছিলেন বাহাউদ্দিন। ঐ পকেটে গ্রেনেড রেখেছিলেন।
আবুল মিয়া যখন বাহাউদ্দিনকে নৌকায় ওঠান তখন সেই জামা একবারে লাল হয়ে গেছে। তাঁর একবারও মনে হয়নি এই জামা তাঁর। অথচ তিনি নিজের গায়ে যেই জামাটি ছিল সেটিও দিয়ে দিলেন বাহাউদ্দিনকে। রক্তাক্ত জামাটি নৌকায় রেখে শুকনো জামাটি পরিয়ে দিলেন বাহাউদ্দিনের গায়ে।

তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় সোনামুড়া পর্যন্ত। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ডাক্তার আক্তার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক। তিনি চিকিৎসা দিলেন। ওখানেই দেখা হয় ডাক্তার জাফরুল্লাহর সঙ্গে। দুজনই আন্তরিকতার সঙ্গে তার চিকিৎসা করেন। অতি সহজেই তিনি সে যাত্রা ধকল সামলাতে সম হন।
ঐ সময় হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেখানকার জয়বাংলা ওয়ার্ডে তখন চিকিৎসাধীন আছেন বাহাউদ্দিন। একটা কিশোর ছেলেকে এভাবে দেখে অবাক প্রধানমন্ত্রী। একজন কিশোর যুদ্ধ করতে পারে এমনটা অভাবনীয় ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। তিনি আবেগে জড়িয়ে ধরেন বাহাউদ্দিনকে। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী বাহাউদ্দিনকে এভাবে স্নেহ করতে পারেন, সেটা ছিল তাঁর জন্য কল্পনারও বাইরে। আনন্দ প্রকাশের  কোনো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবে তাঁর কাছে মনে হয়েছিল তিনি যেন ঐ মুহূর্তেই আবার যুদ্ধেেত্র গিয়ে শত্রু বাহিনীকে একের পর এক খতম করে দিয়ে আসতে পারবেন। মোট কথা ইন্দিরা গান্ধীর এমন স্নেহ তাকে যোদ্ধা হিসেবে আরেক ধাপ সাহসী করে  দেয়।  

ক্যাপ্টেন হায়দার সাহেব বললেন, মেজর বোখারি বিবির বাজার এলাকায় আসে প্রায়ই। তার অবাধ গতি রোধ করতে হবে। টার্গেট করতে হবে এই দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি সেনানায়ককে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।   বোখারিকে ধরতে গিয়ে সেখানে এলেন বাহাউদ্দিন, জামাল, খোকন প্রমুখ। সঙ্গে খুব বড় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। গ্রেনেড ও মাইন। উদ্দেশ্য রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখা। অতি সন্তর্পণে মাইন পোতার কাজটিও করা হলো। অদূরে  নিরাপদ স্থানে গিয়ে তারা অবস্থান নিলেন দেখার জন্য। দেখলেন, বেশ বড় একটি লরি এগিয়ে আসছে বিবির বাজারের দিকে। প্রচণ্ড  আবেগ আর উৎকণ্ঠায় তাদের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় হচ্ছিল। দেখলেন, মাইনের কাছে চলে এসেছে লরিটি। ওখানে এক্সপ্লোসিভও ফিট করা হয়েছিল। গুনতে থাকলেন এক দুই তিন...। হঠাৎ দেখতে পেলেন বিরাট লরিটি উড়ে গেল। কিন্তু সেখানে বোখারী ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর য়তি হয়েছে কেমন তা অনুমান করা সম্ভব হলো না। কারণ তাদের অতি দ্রুত স্থ`ান ত্যাগ করতে হয়েছে।  

ঐ সময় ডাক্তার জাফরুল্লাহ ও ক্যাপ্টেন আক্তার আহমেদ, ডাক্তার মবিন ও সেতারা বেগম প্রস্তাব করলেন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবেন। কিশোর বাহাউদ্দিন বললেন এ কাজেও তিনি সহযোগিতা করতে পারবেন। তিনি বললেন, ওষুধের কোনো অভাব হবে না। তিনি চলে গেলেন চৌদ্দগ্রাম। সেখানে করিম সাহেবের ফার্মেসিতে হাজার হাজার টাকার ওষুধ মজুদ ছিল। তিনি সেই ওষুধ নিয়ে আসবেন বলে দেশে এলেন। যথারীতি সেই ওষুধও তিনি সংগ্রহ করলেন। কিন্তু সেগুলো নেবেন কী করে। এমন সময় তিনি খবর পেলেন ওয়াপদার একটি নতুন পিকআপ রয়েছে হরিপুর ব্রিজের কাছে।   সেই পিকআপই তিনি ওষুধ পরিবহন কাজে ব্যবহার করলেন। পুরো কাজে আকবর হোসেন সাহেব ছিলেন দিকনির্দেশকের ভূমিকায়।

অবাক কাণ্ড হচেছ, ওষুধভর্তি গাড়িটি সাধারণ মানুষের সহায়তায় ঠেলতে ঠেলতে ভারতের রাধানগর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হলো। সুতরাং হাসপাতালের জন্য ঐ মুহূর্তে ওষুধ ও গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিন্তু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। সেই কাজেও অনন্য ভূমিকা পালন করলেন বাহাউদ্দিন। তিনি এবার নোয়াবাজার হাসপাতালে গিয়ে সেখানকার যন্ত্রপাতি নিয়ে এলেন মুক্তিযুদ্ধ হাসপাতালের জন্য। এসব কাজের জন্য নিকটবর্তী ভারতীয় এলাকায় ক্যাম্প করার প্রয়োজন। তাও করা হলো। রাধানগর এলাকায় সেই ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হলো। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজস্ব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরো বেড়ে যায়। সেখানে লুলু আপা, টুলু আপা, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, আক্তার আহমেদ, পদ্ম ও অন্যরা আন্তরিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হলেন।

তারপরের অপারেশন করেন জুলাই মাসের মাঝামাঝি। সেটি করেন বাঘমারায়। লাকসাম এলাকায় পরিকোট ব্রিজ এলাকায় পরবর্তী অপারেশন। পরিকোট অপারেশন ছিল অতি প্রয়োজনীয়। কারণ লাকসাম হেডকোয়ার্টার থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুমিল্লা ও চাঁদপুর অঞ্চলে অপারেশন চালানোর জন্য এই পথ ব্যবহার করতো। তাই সেখানকার ব্রিজটি ভেঙ্গে দেওয়া ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য খুবই জরুরি একটি কাজ। সেক্টর হেডকোয়ার্টার  থেকে বলা হলো পরিকোট ব্রিজ ধংস করতে হবে। রেকিও করা হলো যথারীতি। দু দিন লেগেছিল রেকি করার জন্য। এটা করা হয়েছিল বাহাউদ্দিনদের এলাকায় আসারও আগে।

বাহাউদ্দিনের সঙ্গে ছিল এফএফ ছিল ৪জন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের আবু তাহের ও আব্দুল করিম ছিলেন। তাদের নেতৃত্বেই ব্রিজটা উড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করতে হবে। কিরণ সাহ নামের একটি জায়গা আছে। নদীর মাঝখানে ছোট একটি গ্রাম। চতুর্দিকে পানি আর পানি। সেই গ্রামে গেলেন তাঁরা। ঐ গ্রামে জওয়ান যুবক বলতে কেউ ছিল না। সেখানে গিয়ে আবারো রেকি করার কাজটি করতে হয় তাদের। কারণ ঐ ব্রিজটি ধংস করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও। বেঙ্গলের দুজন সৈনিক এবং জামালকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রুপে কাজ করছিলেন বাহাউদ্দিন।
বাহাউদ্দিন নেমে গেলেন পানিতে। সঙ্গে কিছু এক্সপ্লোসিভ। উদ্দেশ্য ব্রিজের নিচে সেগুলো পুঁতে রাখবেন। এবং এর মাধ্যমে ব্রিজটি উড়িয়ে দেবেন। পানিতে নেমে মাথায় লাগিয়ে নিলেন কিছু কচুরিপানা। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকেন ব্রিজের দিকে। নির্দেশ অনুযায়ী সেই এক্সপ্লোসিভ তিনি ব্রিজের সঙ্গে লেপ্টে দেন। তারপর নিরাপদ দূরত্বে চলে আসেন। ব্রিজের মাঝখানে একটি পিলার এবং এক পাশে এক্সপ্লোসিভ লাগানো হয়েছিল। এক পর্যায়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে সম হলেন তাঁরা। এই ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়ে হানাদার বাহিনীর অবস্থানকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম হলেন। তারপর দ্রুত তারা হারিসিধা বাজার হয়ে আবার চলে যান রাধানগর। তবে পরবর্তীকালে পাকিস্তানিরা আশপাশের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়।

তারপর বিবির বাজার এলাকায় বড় অপারেশন হয়। সেখানে জামাল, খোকন এবং মেজর আক্তার এই অপারেশনে যোগ দেন। সোনামুড়া দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। ওপারে পাকা বাংকার করে পাকিস্তানিরা অবস্থান নিয়েছে। ভোর রাতে কানে আসে নারীদের চিৎকার। সেই চিৎকার শোনার পর তাদের মনে হচ্ছিল যে ঐ মুহূর্তেই হারমাদ বাহিনীর লোকদের শেষ করে দেবেন। বাহাউদ্দিন এই অবস্থায় নিজেকে সামাল দিতে পারছিলেন না। কিন্তু আক্তার আহমদ তাকে থামাতে চেষ্টা করেন। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন এভাবে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তারপরও বাহাউদ্দিন ফায়ার করে বসেন। দীর্ঘস্থায়ী হয় সেই ফায়ার। এক পর্যায়ে বাহাউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চাদগমন করেন। কারণ তাদের অস্ত্রের পরিমাণ  ছিল কম। পাশাপাশি পাকিস্তানিদের সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল অনেক উন্নত।

দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে চৌদ্দগ্রামে তাঁরা শেষ অপারেশনটি করেন। সেখানে তিনি আহত হন। চিকিৎসা শেষে মাকে দেখার জন্য আসেন দেশে। দুয়ারা বাজারে একসময় একটা রাজাকারকে ধরে ফেলেন। রাতের বেলা তিনি খবর পেয়েছিলেন ওরা লুট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি একা গেলেন সেই অপারেশনে। তার আগে ক্যাপ্টেন হায়দার বলেছিলেন, যে কোনো উপায়ে হোক রাজাকারটাকে ধরে নিয়ে আসতে হবে। সেই রাজাকারটিকে ধরে নিয়ে যান সোনামুড়ায়। কীভাবে যেন এই রাজাকার বেঁচে যায়। দীর্ঘদিন পরে বাহাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় কুমিল্লা নিউমার্কেট এলাকায়। তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন বাহাউদ্দিন। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষ ধাওয়া করে রাজাকারটিকে।
বাহাউদ্দিন রেজা বীর প্রতীকের বাবার নাম আলহাজ্ব জুড়া মিয়া মাস্টার, মা হাফেজা খাতুন। গ্রাম নোয়াপাড়া, চিওড়া, থানা : চৌদ্দগ্রাম, জেলা : কুমিল্লা।

বাংলাদেশ সময় ২১৫০, ডিসেম্বর ১৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad