ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা নিয়ে বেঁচে আছেন সেই কাদের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১০
বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা নিয়ে বেঁচে আছেন সেই কাদের

কলকাতা: কলকাতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম জীবিত সাক্ষী কাদের মিঞা, ডাক নাম খোকা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন কলকাতাস্থ পাকিস্তান উপদূতাবাসের পিওন।

বাংলাদেশের বাইরে ওই দূতাবাসেই প্রথম উড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। আর উপদূতাবাসটির স্বাধীনতার ঘোষণার যে দলিল, রাতভর তার সাতশ কপি তৈরি করেছিলেন কাদের। তারপর পৌঁছে দিয়েছিলেন গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে। এখন তার বয়স ৭০। থাকেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে। বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রক্তিম দাশ তাকে খুঁজে বের করে তুলে এনেছেন কাদের ও কলকাতার সেই উপদূতাবাসের অনেক অজানা কাহিনী।

১৯৫৩ সালে কলকাতার পাকিস্তান উপদূতবাসে কর্মরত জনৈক সাত্তার সাহেব বর্ধমানের কেতুগ্রামের ১৬ বছরের কাদের মিঞাকে নিয়ে আসেন অস্থায়ী কর্মী হিসেবে। তখন উপরাষ্ট্রদূত ছিলেন খাজা নাসুরউল্লা।

‘৬৮ সালে কাদের মিঞা হয়ে যান উপরাষ্ট্রদূতের ম্যাসেঞ্জার। ভালোই চলছিল। এরই মধ্যে এসে গেল উত্তাল সত্তরের দশক। পাকিস্তান জাতীয় সংসদে ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পশ্চিমারা বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করতে টালবাহানা শুরু করল। তার ছোঁয়া এসে লাগল কলকাতা উপদূতাবাসে। তখন উপরাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। প্রেস সচিব মকসুদ আলী। আর ছিলেন আনোয়ার করিম চৌধুরী।

‘৭১-র ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ : ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। ... ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। ’  শোনার পর থেকেই কাদের বুঝতে পারছিলেন কিছু একটা হতে যাচ্ছে। উপদূতাবাসের ভিতরে অবাঙালিরা বাঙালিদের সন্দেহ করছে।

খলিল সাহেব বলে এক পাক সেনা গোয়েন্দা একদিন তাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি সাচ্চা মুসলমান। দাড়ি রাখো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো। ঠিক করে বলো, এই মিশনে কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে?’

কাদের চোয়াল শক্ত করে ঠাণ্ডা মাথায় মিথ্যা বললেন, ‘আমি কিছু জানি না, স্যার। এখানে কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক নাই। ’

কাদেরের ততদিনে জানা হয়ে গেছে, পাক সরকারের চাকরি করলেও মিশনের সব বাঙালিই দেশের স্বাধীনতা চাইছেন। তিনিও তাই চান।

মকসুদ সাহেব খুব ভালো বাসতেন কাদেরকে। সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতেন নিজের চাচাত ভাই বলে। কাদের তখন তার সঙ্গেই থাকেন। অফিসের কাজের পর বাসায় গিয়ে মকসুদ সাহেবের জন্য রান্না করেন। এই সময় খবর এল মকসুদ সাহেবকে ১৫ দিনের মধ্যে লাহোর চলে যেতে হবে।

কাদেরকে তিনি বললেন, ‘ভিক্ষা করে খাব। তাও ওই হানাদার খুনিদের পাকিস্তানে যাব না। একটা কিছু করতেই হবে। ’

এদিকে প্রতিদিনই দূতাবাসের বাইরে মঞ্চ করে পাকিস্তানকে গালিগালাজ শুরু করল বাংলাদেশের কলকাতা প্রবাসীছাত্ররা। তারা হোসেন আলী সাহেবকে রাজাকার, পাকিস্তানের দালাল বলে মাইকে চিৎকার করত, স্লোগান দিত।

একদিন থাকতে না পেরে হোসেন আলী সাহেবকে কাদের বললেন, ‘স্যার কিছু একটা করেন। এরা আপনাকে গালিগালাজ করছে। ’

‘এখন সময় হয়নি’, বললেন হোসেন আলী।

এভাবেই দিনে দিনে উত্তাল হতে থাকল পরিস্থিতি। এল ১৭ এপ্রিল। আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি পড়ছে। মকসুদ সাহেব বিকেলে কাদেরকে বললেন, ‘আজ রাতে বাসায় যেও না। কাজ আছে। ’

কাদের বুঝলেন, সময় হয়েছে।

রাত সাড়ে ১২টা। মিশনে মাত্র চারজন। হোসেন আলী, মকসুদ আলী, আনোয়ার চৌধুরী আর তিনি।

হোসেন সাহেবের ঘর থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসে মকসুদ সাহেব বললেন, ‘কাদের, এই নাও। এটা ৭০০ কপি সাইক্লোস্টাইল করে ফেল। কাল সকালেই লাগবে। ’

সাইক্লোস্টাইল করতে করতে কাদের পড়ছেন, ‘আমি হোসেন আলি। আমি ২২ বছরের পাকিস্তান সরকারের চাকরি থেকে পদত্যাগ করছি। পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন থেকে ইস্ট পাকিস্তান বেশি দূরে না। পাকিস্তানিরা যে অত্যাচার করছে আমার দেশবাসীর প্রতি তা আমি সহ্য করতে পারছি না। তাই ছাড়লাম...। ’


ভোর নাগাদ কাজ শেষে হাতের ঘোষণাপত্রটা দেখলেন কাদের। তাতে লেখা, ‘আজ থেকে এই দূতবাস আর বর্বর পাকিস্তানিদের নয়, বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রের দূতাবাস। ’

ততক্ষণে হোসেন আলি সাহেবের ঘরে চলে এসেছে সবুজের ওপর স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা পতাকা। কলকাতার হিন্দু এলাকায় গোপনে তৈরি করা হয়েছে তা।

বিনিদ্র রজনী কাটানো ক্লান্ত মকসুদ সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কাদের চা করো এবার। চা নিয়ে হোসেন সাহেবের ঘরে ঢুকে কাদের শুনতে পেলেন, ‘আজ রোববার। আর্মির লোক পাকিস্তানি ৩৩ জন, আর আমরা ৬৫। ওরা আজ আসবে না। ১১টার দিকে গিয়ে মওলানা সাহেবকে ডেকে আনতে হবে। তার পর...। ’

মওলানা সিদ্দিক সাহেব এলেন সকাল সাড়ে ১১টায়। হাইকমিশনের ছাদের ফ্ল্যাগস্টান্ডের নিচে লাগানো হলো বাংলাদেশের পতাকা। স্ট্যান্ডের মাথায় তখনও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। দূতাবাসের বাইরে তখনো বাংলাদেশী ছাত্ররা জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছে- ‘রাজাকার, রাজাকার। ’

ঘড়িতে ১১টা ৫৫। ধীর পদক্ষেপে ফ্ল্যাগস্টান্ডের দিকে এগিয়ে চললেন উপরাষ্ট্রদূত হোসেন আলী, সঙ্গে মকসুদ আলীসহ অন্যরা। তাদের দেখে স্লোগান আরও তীব্র হলো। কান পাতা দায় : ‘রাজাকার-রাজাকার, পাকিস্তানের দালাল। ’

হঠাৎই থেমে গেল স্লোগান। মুখরিত কোলাহল পরিণত হলো পিনপতন নিস্তব্ধতায়। পাকিস্তানের পতাকা নিচে নেমে গেছে। আস্তে আস্তে উপরে উঠছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মুহূর্তের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চিৎকার করে ওঠলেন হোসেন আলী, ‘জয় বাংলা। গলা মেলালেন মিশনের সব বাঙালি। কান্নাভেজা গলায় কাদেরও চেঁচিয়ে বললেন, ‘জয় বাংলা। ’

নিচের মঞ্চে ছাত্ররা আনন্দে নাচতে নাচতে স্লোগান দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে প্রথম উঠল স্বাধীন বাংলার পতাকা। মাইকে তখন বাজছে : আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।

খুলে গেল মিশনের লোহার দরজা। দলে দলে ছাত্ররা ভেতরে ঢুকে জড়িয়ে ধরলেন হোসেন আলীসহ সবাইকে।

ভিড়ের মধ্যে মকসুদ সাহেব বললেন, ‘কাদের, ওই সাইক্লোস্টাইল চিঠিগুলো পিটিআই, ইউএনআই, আকাশবাণী, বসুমতি, যুগান্তর, আনন্দবাজারে দিয়ে এসো। ওদের বলো, আজ আমরা স্বাধীন। ’

এরপর স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। পেরিয়ে গেল আরো তিন যুগ। ২০০৩ সালে চাকরি হারালেন কাদের। তৎকালীন উপরাষ্ট্রদূতের কাছে আবেদন করেছিলেন তার একটি ছেলেকে অন্তত যেন চাকরি দেওয়া হয়। কিন্তু ওই আবেদনের সাড়া পাননি কাদের। এমনকি চাকরির শেষ দিনটিতে পাননি কোনো বিদায় সংবর্ধনা।

আজ কেউ মনে রাখেনি ভিনদেশি কাদেরকে। মনে রাখেনি, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবের কথা রেখে সংগ্রামের ছয় মাস বেতন নেননি। কলকাতা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে এক গণ্ডগ্রামে নিভৃতেই তিনি আছেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথা স্মরণ করে সজল চোখে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘কলকাতায় বঙ্গবন্ধু এসে বলেছিলেন, কিছুই আনতে পারিনি তোমাদের জন্য, নিয়ে এসেছি ভালোবাসা। ওই ভালোবাসা নিয়ে এখনো বেঁচে আছি। ’

বাংলাদেশ সময় ১৬৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।